দেশের একমাত্র প্রবাল পাথরের দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এ দ্বীপের পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষায় আর কোনো বহুতল ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ না করতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। পরিবেশ বিরোধী কর্মকান্ড ঠেকাতে পর্যটক সীমিত করতে সংশ্লিষ্ট জাহাজ মালিক ও ট্যুর অপারেটর অ্যাসোশিয়েসন (টুয়াক) কে কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে। যা দ্বীপের অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রাখা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
পর্যটকের আনাগোনা কম থাকায় অনেকটাই সুনসান দ্বীপের এদিক সেদিকে এখন দেখা মিলেছে ভিন্ন দৃশ্যের। আরো বেশি পর্যটকের থাকার আয়োজনের জন্য চলছে নির্মাণ কাজের তোড়জোড়; নিয়ম না মেনেই যেগুলো করা হচ্ছে বলে উঠেছে অভিযোগ। কিছুটা কম কোলাহলের এ সময়ে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি ঘুরে দেখা গেছে, নতুন করে বেশ কয়েকটি হোটেল, রিসোর্ট ও ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে প্রায় সবখানেই। বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই সেখানে নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে। নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ এসব স্থাপনার চারদিক টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে কাজ করছেন, যাতে লোকজন সেখানে ঢুকতে না পারে।
সাগরের মাঝে একটুকরো দ্বীপ তা ও আবার বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমানা প্রচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ দ্বীপ সাগর গর্ভে তলিয়ে গেলে ল্যান্ড বাউন্ডারি ও সমুদ্রসীমা নিয়ে দেখা দিতে পারে বিরোধ।
নয়নাভিরাম এ দ্বীপ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ছোট্ট এ দ্বীপের গলাচিপা এলাকায় নির্মাণ কাজ চলছে বেশি। পাশাপাশি ডেইল পাড়া, দক্ষিণপাড়া, পূর্বপাড়া ও উত্তর সি বিচ এলাকায় নতুন ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি পুরনো রিসোর্ট বা হোটেল চত্বরে নতুন ভবন নির্মাণের কাজও চলছে।
ইটপাথর দিয়ে নতুন এসব স্থাপনা ‘অবৈধভাবেই’ গড়ে তোলা হচ্ছে। আগে থেকেই অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনার সংখ্যা প্রায় ২০০টি বলে সেখানকার পরিবেশ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যে বলা হয়েছে। অথচ আইন অনুযায়ী, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পুরনোগুলো উচ্ছেদ করার কথা। কিন্তু সেটা তো দূরের কথা, প্রতিদিন সেখানে বাড়ছে অবৈধ স্থাপনা। ইট-কাঠের জঞ্জালে প্রতিদিন মারাত্মক হুমকিতে পড়ছে দেশের একমাত্র এ প্রবাল দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ।
এসব বিষয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে অবস্থানরত পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক ফাইজুল কবির বলেন, ‘গত বছর (২০২২) পর্যন্ত দ্বীপে অবৈধভাবে নির্মিত রিসোর্টের সংখ্যা ছিল ১৯২টি। এরপর আরো নতুন করে স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। ‘আমরা সেগুলোর তালিকা করছি। নতুন ১৪টি পাকা ও আধাপাকা রিসোর্ট মালিককে নোটিশ দিয়ে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এরই মধ্যে অনেক স্থাপনার কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের সভায় সেন্ট মার্টিনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তালিকাও হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও পরিবশে অধিদপ্তর দ্রুতই অভিযানে নামবে।’
উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবাদীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার বিভিন্ন রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ মূলত পর্যটন মৌসুম বন্ধের সময়কালে তাদের স্থাপনাগুলোর নির্মাণ কাজ শুরু করে। যাতে কারও নজরে না আসে। একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত অর্ধশতাধিক স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে।
তারা বলছেন, টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে নির্মাণ সামগ্রী নেয়া নিষিদ্ধ। সরকারি কাজের জন্য নিতে হলেও উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। তবে কিছু অসাধু ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী রাতের আঁধারে এসব নির্মাণ সামগ্রী দ্বীপে নিয়ে যায় নিয়মিত। কয়েকজন এমন অভিযোগও করেন, সরকারি কাজের কথা বলেও অনেক সময় এগুলো পরিবহন করে নিয়ে গিয়ে রিসোর্ট নির্মাণকারীদের কাছে বিক্রি করা হয়।
প্রশাসন এসব স্থাপনা উচ্ছেদের কথা বললেও ‘অজ্ঞাত কারণে’ তা আর হয় না। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তের অদূরে সাগরের বুকে ৮ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার।
এ দ্বীপ সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্র। এখানে এককালে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ট বা কড়ি জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, পাঁচ প্রজাতির ডলফিন, চার প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, দুই প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির প্রাণীর বসবাস ছিল। কালের ধারায় এসব প্রজাতির অনেকগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এসব জীববৈচিত্র্য। এই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনের ৫৯০ হেক্টর এলাকাকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করেছিল সরকার।
এ অবস্থার মধ্যেই একমাত্র এ প্রবাল দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে প্রতি বছরই সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে। পর্যটক টানতে রিসোর্টগুলোও আধুনিক ইট-কাঠের ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ করছে। ফলে পরিবেশ প্রতিদিন হুমকির মধ্যে পড়ছে।
সরেজমিনে গিয়ে ঘুরে দেখা যায়, দ্বীপের বেশ কিছু জায়গায় স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। কিন্তু এর ধারে কাছে ভেড়ার কোনো উপায় নেই। কড়া নিরাপত্তা। অনেক ক্ষেত্রে কাজের জায়গায় শুধু শ্রমিকদের দেখা যায়, যারা এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চান না। কয়েকজন শ্রমিক জানালেন, তারা মালিকের কাজ করছেন। দিনমজুরি নিচ্ছেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। মালিক কে, সেটিও জানেন না কিংবা বলতে চান না।
দ্বীপের দক্ষিণপাড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ড ‘লুইপাস ইকো রিসোর্টে’ বেশ কয়েকটি ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। সেখানকার ভবনগুলো রক্ষার জন্য সমুদ্র সৈকতে ইট, সিমেন্ট, লোহা আর বালু দিয়ে রক্ষাবাঁধ তৈরি করা হয়েছে।
কিছুটা দূরের কোনাপাড়ায় ‘সমুদ্র কুটির রিসোর্টের’ পাশে একটি ভিআইপি কটেজ নির্মাণের কাজ চলছে। এক বাউন্ডারিতে সাতটি কটেজ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। রিসোর্টটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন মো. আবছার নামে এক যুবক।
তিনি জানান, রিসোর্টটির মালিক ঢাকার এক ব্যবসায়ী, কিন্তু নাম বলতে রাজি না তিনি। সেন্টমাটিনের ডেইল পাড়ার উত্তর সীবিচে ‘হোটেল রয়েল বিচে’ তৃতীয় তলার কাজ চলছে। কয়েকবার চেষ্টা করেও এটির কারও সঙ্গে কথা বলা যায়নি। পরে তাদের ফেসবুক পেজ থেকে বুধবার সকালে যোগাযোগের নম্বর নিয়ে কল করা হলে একজন সেটি ধরেন। কিন্তু সাংবাদিক পরিচয় শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেটে দেন। পরে আবার ফোন দিলেও কেউ সাড়া দেয়নি।
ভোরের আকাশ/নি