logo
আপডেট : ২৩ অক্টোবর, ২০২৩ ১২:৪৫
৫শ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকঢোলের হাট
কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি

৫শ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকঢোলের হাট

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর পুরাতন বাজারে বসেছে ঐতিহ্যবাহী ঢাকঢোলের হাট

কারো হাতে সানাই, কারো হাতে বাঁশি, করতাল ও মঞ্জুরিসহ নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র, কাঁধে ঝুলছে ঢাক। হঠাৎ করে দেখে মনে হতে পারে বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী দেখাতে এসেছেন সবাই। কিন্তু আদতে তা নয়। এদের সবাই এসেছেন শ্রম বিক্রি করতে। রীতিমতো হাট বসিয়ে চুক্তিবদ্ধ হন তারা।

 

জেলার কটিয়াদী উপজেলায় শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে প্রতি বছর উপজেলা সদরের পুরাতন বাজারে ৫শ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকঢোলের হাট বসে। পূজার আয়োজকগণ দেশের প্রায় সর্বত্রই সুনাম ছড়িয়ে পড়া এই হাটে ছুটে আসেন ভালো মানের বাদক নিতে। পূজামন্ডপগুলোও ইতোমধ্যে সুসজ্জিত হয়ে উঠেছে। লগ্ন শুরু হলেই ঢাকঢোলের তালে পূজারিদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে পূজামন্ডপগুলো। তাই দূর-দূরান্ত থেকে ঢাকঢোল, সানাই, বাঁশি নিয়ে বাদ্যযন্ত্রিদের আগমণ শুরু হয়ে গেছে।

 

আয়োজকরা জানায়, এখানে ছাড়া দেশের কোথাও এ ধরনের বাদ্যযন্ত্রের হাট বসে না। তবে এ হাটে কোনো কেনাবেচা হয় না। পূজামন্ডপে বাজনা বাজিয়ে আরতি দেয়া, দুর্গা মাকে খুশি করা আর দর্শক ভক্তদের আকৃষ্ট করতেই যন্ত্রি বা ব্যান্ড পার্টি চুক্তিভিত্তিকভাবে এখান থেকে ভাড়া দেয়া-নেয়া হয়।

 

ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, ঢাকা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক দুর্গাপূজার আয়োজকরা এ হাটে এসে দরকষাকষি শেষে চুক্তিতে বাদ্যযন্ত্রিদের নিয়ে যায়। পরে দুর্গোৎসবের শেষদিন প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত বাদ্য বাজিয়ে যন্ত্রিদের বিদায় দেয়া হয়।

 

মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের ভাটি অঞ্চল, কুমিল্লার হাওরাঞ্চল থেকে শত শত বাদ্যযন্ত্রি এ হাটে আসেন। ঢাকঢোল, সাঁনাই, বিভিন্ন ধরনের বাঁশি, কাঁসি, কওলাসহ হাজার হাজার বাদ্যযন্ত্রের পসরায় হাট উপচে পড়ে। যন্ত্রিরা দলে দলে দফায় দফায় বাজায় বাদ্যযন্ত্র। বাজনার তালে তালে নাচ আর অঙ্গভঙ্গিতে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে থাকে।

 

একটি ঢাক ১২-১৫ হাজার, ঢোল ১০-১২ হাজার, বাঁশি প্রকারভেদে ১০ থেকে ২০ হাজার, ‘ব্যান্ডপার্টি’ ছোট ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার এবং বড় ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দেয়া হয়। বাদ্যযন্ত্রিরা পূজামন্ডপে বাজনা বাজিয়ে দর্শক ও ভক্তদের আকৃষ্ট করে থাকেন। দুর্গাপূজা শুরুর দিন থেকে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত টানা ৫ দিন তাদের বাজনা বাজাতে হয়।

 

সিলেট বিয়ানিবাজার থেকে এসেছেন আব্দুল মালিক। তিনি জানান, ‘কটিয়াদীর ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাটে আমরা আসি। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঢাক বাজাতে চলে যাই। গত বছর পাঁচ দিনের চুক্তিতে সিলেটের একটি পূজামন্ডপে গিয়েছিলাম। এ বছরও বিভিন্ন জায়গার লোকজনের সঙ্গে কথা চলছে।’

 

শ্রীনগর মুন্সীগঞ্জ থেকে জীবন চন্দ্র দাস জানান, ‘আমার বাপ-দাদারা এই হাটে আসতেন। ১০ বছর ধরে আমিও এই ঢাকের হাটে আসি। প্রত্যেকবারই বায়না হয়ে যায়।’

 

জনশ্রুতিতে আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ই সর্বপ্রথম তাঁর রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী মসুয়া গ্রামে বিশ্ব নন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ হরি কিশোর রায় চৌধুরীর বাড়িতে মহা ধুমধামে পূজা শুরু হয়। সেই সঙ্গে চলে বিভিন্ন পূজার বাদ্যযন্ত্রের প্রতিযোগিতা। দিন দিন পূজার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন জমিদারদের মধ্যে ঢাকের হাটের স্থান নির্ধারণ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পরে যাত্রাঘাট থেকে স্থান পরিবর্তিত হয়ে ৫ কিলোমিটার দূরবর্তী আড়িয়াল খাঁ নদের তীরবর্তী কটিয়াদীর পুরাতন বাজারের মাছমহাল এলাকায় ঢাকের হাট গড়ে ওঠে।

 

কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ জানান, পাঁচশ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকঢোলের হাট উপজেলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই হাটটিই দেশের একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় বাদ্যযন্ত্রের হাট হিসেবে পরিচিত। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই এ হাটের গৌরব ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে চলেছে। প্রতিবছর স্থানীয় প্রশাসন আগত বাদ্যযন্ত্রিদের সার্বিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। দিন দিন হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা বাড়তে থাকায় বর্তমানে জায়গা সংকুলান হয় না কটিয়াদী বাজারে। তাই আগামীতে হাটের জন্য একটি ভালো স্থান নির্বাচন করার উদ্যোগ নেয়া হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি