এম সাইফুল ইসলাম: ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ সফলে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছে রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি। মহাসমাবেশ থেকে মহাযাত্রার ঘোষণা দেয়া দলটি সকল প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে এখন মাঠে সক্রিয়। দলটির নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি মোকাবিলা করে এখন ঢাকামুখী। সমাবেশ বাস্তবায়ন এবং যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিএনপি এখন কৌশলী।
মহাসমাবেশে বিপুল উপস্থিতি নিশ্চিতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা সর্বোচ্চ তৎপর। শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা এলে দলটির নেতাকর্মীদের প্রতিরোধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে লাগাতার কঠোর ঘোষণার কর্মসূচি পরিকল্পনা করছে বিএনপি।
বিএনপি নেতারা বলছেন- যেকোনো মূল্যে মহাসমাবেশ সফলে কর্মযজ্ঞ নিয়ে তারা মাঠে। দলীয় হাইকমান্ডের চাওয়া অনুযায়ী সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সমাবেশ করতে চান তারা। সরকারি দলের তৎপরতা ও পুলিশের প্রতিবন্ধকতা মাথায় রেখেই তারা এগোচ্ছেন। এবারের সমাবেশে বাধা এলে প্রতিরোধের হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন তারা।
জানা গেছে, নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে। দলটি চায় নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, নভেম্বরের শুরুর দিকে তফশিল আর জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেই হিসেবে তফশিল ঘোষণার আর মাত্র কয়েকদিন সময় হাতে রয়েছে।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে ১০ দফা ও পরবর্তীতে ১২ জুলাই থেকে সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রাজপথে। দলটির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত রয়েছে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপি ও ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিসহ প্রায় অর্ধশতাধিক দল ও সংগঠন।
কয়েকদফা বিক্ষোভ সমাবেশ, পদযাত্রা, অবস্থান ও অনশনসহ লাগাতার নানা ধরনের কর্মসূচি পালন শেষে গত ১৮ অক্টোবর বিএনপি ঢাকায় গণসমাবেশ করেছে দলটি। ওই সমাবেশ থেকে সরকারকে দাবি মানতে চলমান দুর্গাপূজা পর্যন্ত সময় দিয়ে দলটি ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণার সময় কঠোর কর্মসূচির ইঙ্গিত বলেছেন, মহাসমাবেশ থেকেই যাদের ‘মহাযাত্রা’ শুরু।
বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা বলছেন, ২৮ অক্টোবরে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক সৃষ্টি করতে চান তারা। শান্তিপূর্ণভাবে সর্বোচ্চ লোকসমাগমের উপস্থিতি ঘটিয়ে তারা সরকারকে বিশেষ বার্তা দিতে চান। তারা বোঝাতে চান সরকারের কর্মকান্ডের দেশের বড় একটি বড় অংশের মানুষ ক্ষুব্ধ। তারা সরকারকে ‘না’ বলতে শুরু করেছেন। এছাড়া এই সমাবেশের বিপুল উপস্থিতি ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে যেন বিশেষ বার্তা দিতে সক্ষম হয় সে চেষ্টা রয়েছে সরকারবিরোধীদের।
মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকটাই এখন টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া, পুলিশি হয়রানিসহ নানা বিষয় মাথায় নিয়েই এবার মাঠে নেমেছে বিএনপি। সমাবেশের দুই/তিনদিন আগেই দলটির নেতাকর্মীরা এবার ঢাকায় প্রবেশ করেছেন। বিশেষ করে দূরের জেলার নেতাকর্মীরা আগেই ঢাকায় প্রবেশ করছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশল হিসেবে এবার নেতাকর্মীরা হোটেল বা আবাসিক মেসে উঠছেন না। এছাড়া ঢাকার আশপাশের জেলাসমূহের নেতাকর্মীদের সমাবেশের আগের দিন ওইদিন ভোরে ঢাকায় প্রবেশ করতে বলা হয়েছে। পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের তল্লাশির বিষয়টি মাথায় নিয়েছে দলটি।
চাওয়া অনুযায়ী যদি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে প্রশাসন অনুমতি না দেয় তবে ভিন্ন কৌশল নেবে দলটি। যেকোনো মূল্যে তারা এবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পল্টনের সামনে সমাবেশ করবে। সেক্ষেত্রে একযোগে কয়েকটি এলাকায় থেকে কয়েক হাজার করে নেতাকর্মী পল্টনে এসে জড়ো হবে। যাতে পুলিশ বাধা দেয়ার চেষ্টা করেও আটকাতে পারবে না। এছাড়া ঢাকায় প্রবেশপথসহ কয়েকটি স্পটে অবস্থান নিয়ে সর্বোচ্চ বিক্ষোভ করবে বিএনপি। সেক্ষেত্রে সারা ঢাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে দেবে দলটি।
দলটির একাধিক সূত্র বলছে, শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। তবে, ক্ষমতাসীন বা প্রশাসন যদি সমাবেশ বানচালের চেষ্টা করলেও তাৎক্ষণিক আরো কঠোর কর্মসূচির প্রস্তুত নিয়ে রাখছে বিএনপি। সমাবেশে বাধা দিলে ২৮ অক্টোবর থেকে লাগাতার কঠোর কর্মসূচিতে যাবে বিএনপি। দলটি সচিবালয় ও নির্বাচন কমিশন ঘেরাও,সড়ক ও রেলপথ অবরোধের মতো কর্মসূচি পালনের বিষয়টি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। সবশেষ দাবি মানতে বাধ্য করতে রাজধানীসহ সারাদেশে অবরোধ ও হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচির পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপি ও সমমনাদের। সেভাবে সারাদেশে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে, সমাবেশ সফলে বিএনপি নেতারা হোম ওয়ার্ক অব্যাহত রেখেছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সারাদেশে থেকে কর্মীদের উপস্থিতি নিশ্চিতে জোরালো কাজ করছেন। এছাড়া বিএনপির হাইকামান্ড অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদেরকে দিচ্ছেন বিশেষ নির্দেশনা। দলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের বিপুল উপস্থিতি নিশ্চিতে দলের একজন স্থায়ী কমিটির সদস্যের নেতৃত্বে কাজ চলছে বলেও জানা গেছে। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য পেশাজীবীদের উপস্থিতি নিশ্চিতে কাজ করছেন।
এছাড়া বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলের পাশাপাশি যারা বর্তমান সরকারের অধীনে ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের মাঠে নামতে কাজ করছেন বিএনপির একাধিক নেতা। এসব কর্মকান্ড পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছেন লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ইতোমধ্যে দলটির সমমনাদের সঙ্গে নতুন করে জামায়াত ইসলামও ২৮ অক্টোবর রাজধানীর শাপলা চত্বরে সমাবেশের ঘোষণায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বর্তমান সরকারের অধীনে ভোটে না গিয়ে মাঠে রয়েছে।
আগামী ৩ অক্টোবর দলটি মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। খেলাফত মজলিশের বড় একটি অংশও বর্তমান সরকারবিরোধী অবস্থানে মাঠে। কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দলও এই সরকারের অধীনে ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এসব দলগুলো মূলত বিএনপির সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে বিএনপির আন্দোলনে নতুনমাত্রা পেয়েছে।
ছাত্রদলের সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন নাসির ভোরের আকাশ কে বলেন, সমাবেশ সফলে সব ধরনের প্রচেষ্টা রয়েছে ছাত্রদলের। অভিভাবক সংগঠন বিএনপির নির্দেশনায় আমরা সর্বাত্মকভাবে পালন করব।
যুবদলের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মোরতাজুল করিম বাদরু বলেন, ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ রাজনীতিতে একটি বিশেষ অধ্যায় সৃষ্টি করবে। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতির হবে মহাসমাবেশে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলটির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেছেন, মহাসমাবেশে জনসমাগমের সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি হবে। বর্তমান সরকারের আমলের কষ্টে থাকা মানুষেরা সেদিন সরকারকে না বলে দেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও পুলিশ সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে সেটি মাথায় নিয়েই কাজ করছে বিএনপি। জনগণের ঢেউ আটকানো যাবে না।
তিনি বলেন, বাধা দিয়ে মহাসমাবেশ আটকানো যাবে না। আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা আসলে সেক্ষেত্রে কী করা লাগবে তা নেতাকর্মীরাই ঠিক করবে।
ভোরের আকাশ/নি