খুলনা-মোংলা রেলপথ আগামী ৯ নভেম্বর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশের কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে খুলনার লতা এলাকা থেকে মোস্তর মোড় পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে।
তারা জানিয়েছেন, ওই এলাকার মাটি নরম থাকায় সেখানকার কাচনাপাড়া এলাকার একটি ব্রিজ দেবে গিয়েছিল। যার কিছু অংশ ভেঙে পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সেখানে রেলপথ নির্মাণ করতে বিলম্ব হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয়রা।
খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘খুলনা-মোংলা রেলপথের অধিকাংশ স্থানই নির্মাণ করা হয়েছে বিলের মধ্যে নতুন রাস্তা তৈরি করে। সেখানে মাটি নরম থাকার কারণে কাজ করতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।’
তিনি জানান, মাটি নরম হওয়ার কারণে পাঁচটি সেতুর বেসমেন্ট দেবে গিয়েছিল। সেগুলো সংস্কার করা হয়েছে। এ কারণে ওই এলাকার প্রায় ৪ কিলোমিটার রেলপথ আগে নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন দ্রুত গতিতে কাজ চলছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই রেলপথ পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে। ভারত সরকারের ঋণ-সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান লারসেন অ্যান্ড টার্বো। আর ট্র্যাক লিংকিং করছে আরেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল। রেলপথের ফুলতলা-মোংলা পর্যন্ত ৯টি প্ল্যাটফর্ম রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া শেষ হয়েছে ১০৭টি ছোট ব্রিজ ও ৯টি আন্ডারপাসের নির্মাণকাজ। তবে খুলনার জিরো পয়েন্টসংলগ্ন মোহাম্মদনগর প্ল্যাটফর্মটি পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সেখানকার ভবনের উত্তর পাশের দেয়ালের বড় অংশজুড়েই ফাটল ধরেছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই স্টেশনটি নির্মাণের কয়েক দিন আগেই মাটিভরাট করে কাজ শুরু করা হয়েছে। ফলে নরম মাটি ভবনের ভার সহ্য করতে পারেনি। যে কারণে কয়েক স্থানে ফাটল ধরেছে।
এ প্রসঙ্গে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘উদ্বোধনের আগেই যদি ফাটল ধরে, তবে নির্মাণকাজ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।’ তবে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ আছে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। যদি কোনো ভবন বা স্টেশনে সমস্যা থাকে, তাহলে আমরা তা ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেব না। যে সমস্যা আছে তা সংস্কারযোগ্য, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা সংস্কার করে দেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।’
এ ছাড়া রেলপথটি পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ফিনিশিং, সিগনালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের কাজগুলো এখনো করা হয়নি। তবে রূপসা নদীর ওপর ৫ দশমিক ১৩ কিলোমিটারের রেলসেতুর কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘রেলের ফিটিংস, স্টেশনের সিগনালিং, টেলিকমিউনিকেশনের যন্ত্রপাতি স্টক করে রাখা আছে। উদ্বোধনের আগেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। যেখানে রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে, সেটিও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হবে।’
ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন সহজ করতে ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন হয়। জমি অধিগ্রহণ, রেললাইন ও রেলসেতু নির্মাণসহ পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এরপর পাঁচবার সময় বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। এরইসঙ্গে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকায়।
এই রেলপথের মাধ্যমে মোংলা বন্দরের পণ্য একদিকে যেমন দেশের মধ্যে কম খরচে পরিবহন করা যাবে, অন্যদিকে ভারত, নেপাল ও ভুটানও এটি ব্যবহার করে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করবে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির অগ্রগতিতে রেলপথটি বেশ ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, ‘মোংলা বন্দরের কাছে খুলনা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্পনগরী। পাশের দুই জেলায় বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দর রয়েছে। ধীরে ধীরে যশোরের বেনাপোল থেকে খুলনা হয়ে মোংলা পর্যন্ত একাধারে শিল্পনগরীতে পরিণত হবে। ভৌগোলিক দিক থেকে দেশের সব থেকে বড় অর্থনৈতিক হাব হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এই অঞ্চলটির। তবে পরিবহন পথ সুগম না হওয়ায় এতদিনেও এই অঞ্চলটিতে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। গত বছরে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় রাজধানীর সঙ্গে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার রেল সংযোগ হচ্ছে, ফলে পরিবহন জটিলতা আর থাকছে না।’
উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, ‘খুলনার রূপসা নদী মোংলা হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে। এর দুই তীরে খুলনা থেকে মোংলার জয়মনি পর্যন্ত দেশের সব বৃহত্তর শিল্প গ্রæপগুলো জমি কিনে রেখেছে। ইতোমধ্যে সিলিন্ডার গ্যাসের কয়েকটি ফ্যাক্টরি তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। অন্য বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছে।’
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী বলেন, ‘মোংলা বন্দরে নৌ, সড়ক ও রেলপথের মাল্টিমোডাল যোগাযোগব্যবস্থা চালু হচ্ছে। ফলে পণ্য পরিবহন অনেকটা সহজ হবে।’
ভোরের আকাশ/নি