খুলনা শহরে রিকশা চালিয়ে রোজগার করেন আসাদুল ফকির। তার বাড়ি দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগি গ্রামে। শিবসা নদীভাঙনের ফলে বসতবাড়ি হারিয়ে তিনি শহরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার যখন গ্রামের বাড়ি ছিল, তখন সুন্দরবন ও নদী থেকে মাছ আহরণ করে সংসার ভরণপোষণ বহন করতাম। শহরে এসে বিকল্প কর্মসংস্থান বেছে নিতে হয়েছে। এই রোজগারে আমি আগের মতো সংসার চালাতে পারছি না।’ আসাদুল ফকিরের মতো নদীপাড়ের মানুষ একে একে শহরমুখী হতে হচ্ছে। বাবা-দাদার বসতভিটা ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে বসবাস করতে, তাদের মনে প্রতিনিয়ত পীড়া দেয়।
আসাদুল ফকির বলেন, ‘চোখের সামনে তিলে তিলে নিজের বসতবাড়ি হারিয়ে যেতে দেখার মতো যন্ত্রণা আর নেই। মৃত্যুর পর আমার লাশটা কোথায় দাফন করা হবে, তা নিয়েও ভাবনায় আছি। এক সময়ে আমার সব ছিল। বাড়িতে গরু পালতাম, বিলে ধান রোপণ করতাম। বহুমুখী আয়ের জন্য গ্রামের বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্য জীবন পার করেছি। এখন শহরের জীবনে সবকিছুতে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে।’ দাকোপ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে সুতারখালী, কামারখোলা, তিলডাঙ্গা ও পানখালী ইউনিয়নে নদীভাঙনের ভয়াবহতা সব থেকে বেশি।
দাকোপ উপজেলার চেয়ারম্যান মনসুর আলী খান বলেন, ‘কয়েক বছর আগে করা একটি মূল্যায়ন অনুযায়ী উপজেলায় ভাঙনের কারণে প্রায় ১০ হাজার বিঘা আবাদি জমি বিলীন হয়েছে। এ ছাড়া ৫০ গ্রামের কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।’
সুতারখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. ইয়াছিন শেখ বলেন, ‘১০ থেকে ১২ বছর ধরে নদী তীর ক্ষয় হচ্ছে, কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড আমাদের রক্ষা করার জন্য কোনো টেকসই বাঁধ নির্মাণ করেনি। তারা শুধু কয়েকটি জিও-ব্যাগ ফেলে রেখেছে, যেগুলো জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলে ভেসে যায়। এ কারণে বহু মানুষ তাদের বসতভিটা ও আবাদি জমি হারিয়েছে। ফলে তারা শহরে যেতে বাধ্য হয়েছে।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, জয়নগর, হাটখোলা গেট, গুনারি, কালীবাড়ি, নলিয়ান, জালিয়াখালী, কালাবগি, সুতারখালী, কামিনীবাশিয়া এলাকার বাসিন্দারা নদীভাঙনের ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন। উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া শিবসা, পশুর, ঢাকাই, ভদ্রা, ঝাপঝাপিয়া ও চুনকুড়ি নদীর একাধিক স্থানে ভাঙন ধরেছে। সামগ্রিকভাবে অন্তত ৩০টি স্থানে ১৫ কিলোমিটারের দৈর্ঘ্যরে সমমান উপকূল রক্ষার বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও জিও ব্যাগ ও ব্লক সরে গেছে। ফলে নতুন বাঁধ নিয়েও স্থানীয়দের স্বপ্নে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে।
তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন গাজী বলেন, ‘কামিনীবাশিয়া গ্রামের প্রায় ৩৬টি পরিবার চলতি বছর ভাঙনে তাদের বসতভিটা হারিয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ভাঙনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণই তাদের বাঁচানোর একমাত্র উপায়।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, খুলনার দাকোপ উপজেলায় বন্যা ও ভাঙন থেকে রক্ষা করার জন্য ১৯৬০ সালের পাকিস্তান সরকার ১৫৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছিল। ওই বাঁধগুলোর মেয়াদ ছিল ২০ বছর। তবে ৬ দশক ধরে তা মেরামত করা হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালে আইলা দাকোপের বেড়িবাঁধের মারাত্মক ক্ষতি করে, তার পরবর্তী বছরগুলোতে নদীভাঙনের হার বেড়ে যায়।
পাউবো জানায়, ২০১২-১৩ অর্ধবছরে খুলনাসহ ছয়টি উপক‚লীয় জেলায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প শুরু হয়েছিল। ওই প্রকল্পের আওতায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়নে ৫০ কিলোমিটার এবং বাজুয়া, দাকোপ, বাণীশান্তা, লাউডোব ও কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নে আরও ৫০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের কথা ছিল। এ ছাড়া, প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৬টি কালভার্ট ও স্লুইস গেট নির্মাণের পাশাপাশি নদীশাসনের আরেকটি প্রকল্প ছিল। তবে সেসব কাজ এখনো শেষ হয়নি।
স্থানীয়রা বলেছেন, উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ নির্মাণে স্থানীয় মানুষের মতামত না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে সরকার যেমন আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে, তেমনি সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বলেছেন, উপক‚লের নদীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, ‘২০১৩ সালে যখন কাজ শুরু হয়, তখন নদীগুলোর প্রকৃতি ভিন্ন ছিল। সেই সময়ে অনেক এলাকায় ভাঙনের কোনো লক্ষণ ছিল না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, নদীগুলোর গতিপথ এবং প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে নতুন নতুন এলাকায় ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে।’
প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি জানান, কাজ প্রায় শেষের দিকে রয়েছে। তবে কামারখোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পঞ্চানন কুমার মন্ডল বলেন, ‘নদীশাসন পুরোপুরি না হলে যেকোনো সময় আবার বড় বিপদ ঘটবে। বাঁধে পর্যাপ্তসংখ্যক স্থানে ব্লক ও জিও ব্যাগ ডাম্পিং বা নদীশাসন না হওয়ায় ঝুঁকি কমছে না। পরিকল্পনার ঘাটতি থাকায় ঝুঁকি বাড়ছে।’
ভোরের আকাশ/নি