logo
আপডেট : ৫ নভেম্বর, ২০২৩ ০৯:১৯
গ্রেপ্তার এড়ানোর অজুহাতে  বিচ্ছিন্ন বিএনপি নেতারা
এম সাইফুল ইসলাম

গ্রেপ্তার এড়ানোর অজুহাতে  বিচ্ছিন্ন বিএনপি নেতারা

এম সাইফুল ইসলাম: সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাময়িক গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার নির্দেশনার অজুহাতে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতারা এখন নিম্ন সারির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। ফলে, নেতাদের নির্দেশনা না পাওয়ায় দলটির বেশিরভাগ কর্মী-সমর্থকরা এখন দিশেহারা। ঢাকায় বিএনপির বা অঙ্গসংগঠনের কোনো কোনো নেতা হাতেগোনা কয়েকজনকে নিয়ে ঝটিকা মিছিল করছেন।

 

দেশের বেশিরভাগ জেলা ও মহানগরে কর্মসূচি পালিত হচ্ছে ঢিলেঢালাভাবে। তবে, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও গাজীপুরের কিছু এলাকায় জোরালোভাবে মাঠে নেমেছেন নেতাকর্মীরা। আর খুলনা ও বরিশাল ও রাজশাহী মহানগর এবং বিভাগের বেশিরভাগ স্থানে কর্মসূচি পালিত হচ্ছেই না। ফলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে কর্মী ও সমর্থকদের মাঝে।

 

তবে, বিএনপি নেতারা বলছেন- পুলিশ তাদের প্রতি নির্মমতা শুরু করেছে। তাই তারা কিছুটা কৌশলে মাঠে রয়েছেন। হাইকমান্ডের নির্দেশনায় কর্মসূচি সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে। এছাড়া মানুষ তাদের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি মন থেকে গ্রহণ করেছেন।

 

জানা গেছে, অনেকটাই অপ্রস্তুত অবস্থায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে বিএনপি। ওইদিনের মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে সফল করার পর ধাপে ধাপে শক্ত কর্মসূচিতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল দলটির। কিন্তু এখন তার বাস্তবচিত্র উল্টো। গত ২৮ অক্টোবর পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের পর পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। সংঘর্ষে একজন পুলিশ কনস্টেবল নিহত হওয়ার ঘটনায় দলটির নেতাকর্মীদের নামে হতে শুরু করে একেরপর এক মামলা।

 

দীর্ঘদিনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হলেও সমাবেশ পন্ড হওয়ার পর বিএনপি হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে রয়েছে। মহাসমাবেশ পন্ড হওয়ার পর পরদিন অর্থাৎ গত ২৯ অক্টোবর দলটির পক্ষ থেকে হরতালের ডাক দেয়া হয়। প্রথমেই গ্রেপ্তার হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

 

একে একে গ্রেপ্তার হয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, যুগ্ম-মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হকসহ দলটির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা। সারা দেশে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে বলে দাবি দলটির। দেশব্যাপী ব্যাপক পুলিশি অভিযান ও মামলা দেয়া অব্যাহত রয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন বাড়িতেই থাকতে পারছেন না। সর্বত্র সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।

 

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, চলমান এই অবস্থায় দল বা অঙ্গসংগঠনের জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতি হাইকমান্ডের নির্দেশনা রয়েছে সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি বা অঙ্গসংগঠনের নেতারা বেশিরভাগই এখন নিম্ন সারির নেতা বা কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মাঠে দেখা নেই বললেই চলে। একমাত্র দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রায় প্রতিদিনই মাঠে নামেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করছেন। আর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কেউ কেউ হাতেগোনা কয়েকজন কর্মী নিয়ে মাঠে নেমে ঝটিকা মিছিল করছেন করছেন।

 

ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহব্বায়ক আব্দুস সালাম ও ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব লিটন মাহমুদকে এবং তার অনুসারীদের তেমন কাউকে মাঠে দেখা যায়নি। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপিকে তেমন মাঠে নামতে দেখা যায়নি। ভারপ্রাপ্ত আহব্বায়ক হরহাদ হালিম ডোনারকে একদিন কয়েকজন সমর্থক নিয়ে মিছিল করেছেন বলে জানা গেছে। মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হককে গ্রেপ্তারের আগেও তাকে খুব একটা তৎপর দেখা যায়নি।

 

ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বেনজির টিটুকে মাঠে দেখায় মেলেনি। ঢাকা জেলা বিএনপির সালাউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক নিপুন রায় চৌধুরী মাঠে নেই। গাজীপুরের বিএনপি নেতা রিয়াজুল হান্নানের আন্দোলনের মাঠে খোঁজ নেই বলে কর্মীদের দাবি। তবে, গাজীপুরে কালিয়াকৈর বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঠে নামতে দেখা গেছে প্রায় প্রতিদিনই। এছাড়া নারায়ণগঞ্জেও ব্যাপক পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে মাঠে নামতে দেখা গেছে।

 

গত কয়েকদিনের কর্মসূচি বিশ্লেষণে দেখা গেছে- বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ছাত্রদলের বেশিরভাগ নেতা মাঠে অনুপস্থিত। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল ও সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে একদিনের কর্মসূচিতে দেখা গেছে মহানগর পূর্বের সঙ্গে ঝটিকা মিছিলে। আর সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল সমাবেশের দিন অসুস্থতার কথা বলে একদিনও মাঠে নামেননি। তবে, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে প্রতিদিন কর্মসূচিতে দেখা গেছে।

 

সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আফসান মুহাম্মদ ইয়াহিয়াকে মহানগর উত্তর বিএনপির মিছিলে একদিক দেখা মিলেছে। তারা মাঠে নামেনি তার চেয়ে বড় সংকট সৃষ্ট হয়েছে নেতা কর্মীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কোনো যোগাযোগ নেই। তার বড় প্রমাণ দৈনিক ভোরের আকাশের হাতে আসা ছাত্রদলের সহ-সভাপতিদের একটি হোয়াটসআপ গ্রুপের একটি স্ক্রিন শর্টের কথোপকথনে। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে না পেয়ে বা তাদের কোনো নির্দেশনা না থাকায় গ্রুপে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকেই। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দপ্তরকে দিয়ে ইউনিটগুলোকে নির্দেশনা দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করা হচ্ছে বলেও ওইসব নেতাদের অভিযোগ রয়েছে।

 

জানা গেছে- ছাত্রদলের ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলকে বেশিরভাগ ছাত্রদল নেতাই পাচ্ছেন না ফোনে। কৌশলগত কারণে তিনি নিয়মিত ফোন বন্ধ রাখতেই পারেন তবে বিকল্প যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থাও তিনি রাখেননি বলে অভিযোগ। কঠিন এই সময়ে তার ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।

 

কর্মীরা বলছেন, যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মিল্টন হরতালে মিছিল করেন সাইনবোর্ড এলাকায়। তারা সেখানে অ্যাম্বুলেন্সযোগে যান। ভোরের আকাশের হাতে আাসা ছবিতে দেখা যায় পাশেই একটি অ্যাম্বুলেন্স রেখে মিছিল করছেন তারা। ওই মিছিলের পাশে রয়েছে গণপরিবহনের যানজট। কর্মসূচি মিছিল চলাকালে তাদের পাশে বেশ গণপরিবহন থাকার ছবিটি ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে ইতোমধ্যে। এছাড়া তাদের আর খুব একটা দেখা মেলেনি।

 

স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে আহত হন। তাই তিনি মাঠে নেই। তবে, সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানও মাঠে নামেননি বলে জানা গেছে। সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসানকে মাঠে দেখা গেছে প্রায়ই দিনের কর্মসূচিতে। কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহীন ও সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুল ঝটিকা মিছিল করলেও প্রায় প্রতিদিন দেখা মিলেছে। আর শ্রমিক দলের মাঠে নামার তেমন খবর পাওয়া যায়নি।

 

এদিকে, ঢাকার বাইরের বেশিরভাগ জেলায় কর্মসূচি খুব একটা পালন হচ্ছে না। শুধুমাত্র বগুড়া ও কিশোরগঞ্জ জেলার নেতাকর্মীরা বেশ সক্রিয়। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ মোটামুটিভাবে মাঠে আছে। রংপুর বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় মাঠে নেমেছেন নেতাকর্মীরা। বিশেষ লালমনিরহাটে রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে নেমেছেন। আর রাজশাহীতে শুধুমাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জে ও রাজশাহী জেলায় একদিন মিছিল হয়েছে।

 

আর খুলনা ও বরিশাল মহানগর এবং বিভাগে কর্মসূচি পালিত হচ্ছে না বললেই চলে। বরিশাল বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান একদিন ৮/১০ জন লোক নিয়ে মাঠে নেমে গ্রেপ্তার হয়ে সমালোচনার সৃষ্টি করেছেন। পুলিশের এই তৎপরতার মাঝে তিনি কয়েকজন কর্মী নিয়ে মাঠে নেমে গ্রেপ্তার হওয়ায় নানা আলোচনা হচ্ছে।

 

আর আন্দোলনের সময় সরগরম থাকা খুলনা মহানগরের পরিবেশ এবার একেবারে ভিন্ন খুলনা। এবার সেখানে মিছিল বা পিকেটিং নেই। খালিশপুর থানা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক কাজী সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা এবার খুলনায় কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখিনি। হতবাক হয়েছি। আন্দোলনে খুলনা অন্যতম। অথচ এবার ব্যতিক্রম। মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, দলের কর্মী বা সমর্থক হিসেবে কর্মসূচি পালিত না হওয়ায় কষ্টে আছি।

 

খুলনা মহানগর বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম বলেন, খুলনায় চাপিয়ে দেয়া নেতৃত্বের কারণে খুলনা বিএনপির আজ এই অবস্থা। তিনি বলেন, দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে বাদ দিয়ে খুলনা বিএনপি চলতে পারে না এটা এবার আবারো প্রমাণিত। হাইকমান্ডের বিষয়টি বিচেনায় আনা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

 

আর খুলনা বিভাগের যশোর জেলায় প্রায় প্রতিদিন মিছিল হচ্ছে। সেখানে নেতৃত্বে দেন বিভাগীয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। এছাড়া কুষ্টিয়া জেলা বিএনপিরও একদিন মিছিলের খবর পাওয়া গেছে। বাকি ৮ জেলায় কর্মসূচি তেমন একটা পালিত হচ্ছে না বলেও খোদ কর্মীদের অভিযোগ।

 

এছাড়া অবরোধের মধ্যে বিএনপি নেতা হাফিজ ইব্রাহিমের লঞ্চ চলার খবর ও মহিলাদের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ গাড়ি ভ্রমণ করে আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ায় নানা আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

 

জানা গেছে, বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের যেসব মিছিল-সমাবেশ বা পিকেটিং হচ্ছে সেটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায়। তার নির্দেশনায় সব সংগঠনের দপ্তর থেকে ইউনিটে রাতে নির্দেশনা পাঠানো হয়। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ইউনিটের কর্মীরা কর্মসূচি বাস্তাবায়ন করছেন। এছাড়া ইতোমধ্যে কারা মাঠে আছেন আর নেই তার খবরও রাখতে তিনি মনিটরিং সেল গঠন করেছেন বলে জান গেছে।

 

তবে, বিএনপি নেতারা এসব অভিযোগ ভিন্ন ভাবে ব্যাখা করছেন। তারা বলছেন, পুলিশি নির্মমতা আর মিডিয়ার অপপ্রচারে বিএনপি বিভ্রান্ত হবে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, সরকার প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করছে। কিন্তু কোনো লাভ হবে না। বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল যার ভিত্তি হচ্ছে তৃণমূলের জনগণের শিকড়ে। সিনিয়ররা গ্রেপ্তার হলেও মধ্য সারির ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ নেতৃত্ব দেবেন। তিনি বলেন, বিএনপি মাঠে আছে। আগামীতে থাকবে বিজয় না হওয়া পর্যন্ত।

 

স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, দলের নেতাকর্মীরা মাঠে আছে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে কৌশলী ভূমিকা রাখতে হয় নেতাকর্মীদের। এবারো তার বাইরে কিছু নয়।

 

ভোরের আকাশ/নি