লাভজনক ড্রাগন ফল চাষে বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে (রাজশাহী-নাটোর-নওগাঁ-চাঁপাইনবাবগঞ্জ) দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে ড্রাগন ফলের চাষ। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রধান সমস্যা পানি সংকট, এজন্য ড্রাগন ফল চাষ সেখানে প্রধান সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমেরিকান এ ফলটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলে।
জানা গেছে, ২০০৫ ও ২০০৬ সালে ড্রাগন ফল প্রথম আমদানি করা শুরু হয়। সে সময় চড়া দামে বিক্রি হতো এ ফল। এ ফল থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে নিয়ে আসা হতো। কিন্তু এর এক দশক পর পাল্টে গেছে পেক্ষাপট। এখন দেশেই চাষ হচ্ছে এ ফল। কর্মসংস্থান হচ্ছে হাজারো মানুষের। এখন দেশের বাজারেও সহজলভ্য এ ফল।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ড্রাগন ফল গাছের কোনো পাতা নেই। এটি এক ধরনের ক্যাকটাস-জাতীয় গাছ। তবে এ গাছে ফুল ধরে। ফুল থেকেই হয় ড্রাগন ফল। ফলের গাছ সাধারণত দেড় থেকে আড়াই মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। একটি ফলের ওজন কমপক্ষে ১৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। এর বীজগুলো খুবই ছোট, কালো ও নরম।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রতি বছর ড্রাগন ফলের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজশাহী জেলায় ২১৪ হেক্টর জমিতে হয়েছে ড্রাগন চাষ। উৎপাদন হয়েছে ৪ হাজার ৪১৮ টন। নাটোর জেলায় ১৩৪ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৫৪৫ টন। নওগাঁ জেলায় ৪৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ৩৬০ টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৭ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে হয়েছে ৩২৫ টন।
২০২১-২২ অর্থবছরে রাজশাহী জেলায় মাত্র ৫৭ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল ড্রাগন। উৎপাদন ছিল ৬৮৮ টন। নাটোর জেলায় ৬৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ৫৫২ টন। নওগাঁয় ২৬ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ২২০ টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৩ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ২৩৪ টন।
২০২০-২১ অর্থবছরে রাজশাহী জেলায় ২৭ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছিল ৩২৪ টন। নাটোর জেলায় ৪০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৬৪০ টন। নওগাঁয় ২২ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল ১০৮ টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৪ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ২ টন।
চাষিদের ভাষ্য, স্বল্প খরচ, অধিক উৎপাদন, পর্যাপ্ত বাজার চাহিদা, পুষ্টিগুণ এবং ভালো দাম পাওয়ায় ড্রাগন ফল চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। ড্রাগনের বাগান তৈরির পর সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এর চারা তৈরির কাজও খুব সহজ। ডাল কেটে মাটিতে বপন করলেই সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে ড্রাগন গাছ।
রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার ড্রাগন চাষি শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর থেকে এ ফল চাষ করে আসছি। এ বছরে আবারো শুরু হয়েছে চাষ। এবার ২৭ একর জমিতে ড্রাগনের চাষ করা হবে। এর চাষ প্রতি বছর বাড়ানো হচ্ছে। স্বল্প খরচে অধিক লাভের কারণে এর চাষ বাড়ছে। দ্রুত ফল পাওয়ার জন্য ড্রাগন গাছে অতিরিক্ত আলো দেয়া হয়। এতে দ্রুত ফল দেয় গাছ।’
রাজশাহীর স্থানীয় বাজারেও কম দামেই মিলছে এ ফল। রাজশাহীর নগরীর শালবাগান এলাকার মোশারফ ফল ভান্ডারের মালিক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় ড্রাগন ফল বিক্রি করা হচ্ছে। এক সময় বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এখন আর আমদানি করতে হয় না। বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদন করা ড্রাগন ফল নগরীতে সরবরাহ করা হয়।’
রাজশাহী নগরীর উপশহর এলাকার ক্রেতা সেতেরা বেগম বলেন, ‘আমি নিয়মিতই ড্রাগন ফল কিনে থাকি। আগে বিদেশি ড্রাগন ফলটা কিনতাম। এখন সেটি বাজারে পাওয়া যায় না। দেশে উৎপাদিত ড্রাগন ফলটা বেশি পাওয়া যায়। দেশে উৎপাদিত ফলটাও স্বাদে তেমন খারাপ লাগে না।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর ইউনিয়নের পুনরচাঁদপুর গ্রাম সংলগ্ন ভাগলপুর মাঠে এক মাস আগে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ড্রাগন বাগান করেছেন আসমাউল হক। তিনি বলেন, ‘এলাকার অন্যদের ড্রাগন বাগান দেখে উৎসাহিত হয়ে ১২ বছরের চুক্তিতে একটি জমি বর্গা নিয়ে ৮ হাজার ড্রাগন চারা রোপণ করেছি। এতে উপজেলা কৃষি বিভাগের সহযোগিতা নেয়া হয়েছে।’ রাজশাহীর পবা উপজেলার মোহনপুর এলাকায় ২৬ কাঠা জমিতে ড্রাগনের চাষ করেছেন মো. বজলুর রহমান। ড্রাগন গাছে আগাম ফুল ও ফল পেতে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে কৃত্রিম দিন করে রাখেন তিনি।
তার দাবি, এভাবে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে রাখলে ড্রাগন গাছে আগাম ফুল আসে। তার জমিতে ইতোমধ্যে ড্রাগনের ফুল আসা শুরু করেছে। তিনি আরো জানান, শুধু রাজশাহী শহরে নয়, রাজশাহী অঞ্চলের আমের মতো ড্রাগন ফলও দেশের বিভিন্ন এলাকায় রপ্তানি করে থাকেন চাষিরা।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, ‘জেলার গোদাগাড়ীতে সবচেয়ে বেশি ড্রাগনের চাষ হয়। পোড়ামাটির অঞ্চল হিসেবে খ্যাত এলাকার মাটি ড্রাগন চাষে বেশি উপযোগী।’
ভোরের আকাশ/নি