নিখিল মানখিন: বিএনপি-জামায়াত মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। জোটবদ্ধভাবেই নির্বাচনে যাচ্ছেন তারা। জোটের শরিকরা মাঠে সক্রিয় থাকছেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। জোট শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। শরিকদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নানা কৌশলে উপস্থিত থাকছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
ছন্নছাড়া ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে ঘন ঘন আলোচনায় বসছেন তারা। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে শরিকদের মানসিক দূরত্ব কমেছে। মনে ক্ষোভ থাকলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে চলেছেন জোটের শরিক দলের নেতারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি ও আন্তর্জাতিক মহলের পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ চাপ অনুভূত হচ্ছে আওয়ামী লীগের দুর্গে। ফলে জোট শরিকদের কদর বেড়েছে আওয়ামী লীগে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), ন্যাপ, জাতীয় পার্টি (জেপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী), বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, গণতন্ত্রী পার্টি, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাসদ, গণআজাদী লীগ, বাংলাদেশ জাসদ (আম্বিয়া) ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নানা কৌশলে রাজনৈতিক মাঠ দখলে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। দল এবং তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সম্মেলন এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে বিদ্যমান কোন্দল নিরসনের পাশাপাশি জোট শরিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়িয়েছে দলটি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি নিজেদের জোট সম্প্রসারণের কাজ করেছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল ১৪ দলীয় জোট শরিকদের। ২০২৩ সালের শেষ সময় পর্যন্ত জোট থাকলেও মাঠে দৃশ্যত একা হয়ে পড়ে দলটি। ভোট বাড়ানোর চেষ্টায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের এককভাবে মাঠে থাকা, শরিক দলগুলোর পাশে না থাকা নিয়ে রাজনীতির অন্দরমহলে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। বর্তমান মন্ত্রিসভায় ১৪ দলের অন্য দলগুলোর অংশগ্রহণ না থাকায় এ নিয়ে অসন্তোষ ছিল শুরু থেকেই।
দলগুলোর সূত্র জানায়, পরিস্থিতি বিবেচনায় জোট শরিকদের ব্যাপারে টনক নড়েছে আওয়ামী লীগের। নির্বাচন সামনে আসায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উপনির্বাচন ছাড়া ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে আওয়ামী লীগের পাশে দেখা যায়নি। তবে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শোক দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উদযাপন, মে দিবস এ ধরনের দিবসভিত্তিক আলোচনা সভাগুলো একসঙ্গে করে আসছে তারা।
সম্প্রতি রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর বাসায় ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা এক বৈঠকে বসেন। এ বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বৈঠকে ছিলেন এমন একটি সূত্র জানায়, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, ক্ষমতাসীন দলের একতরফা নির্বাচনী প্রচারণা, শুধু ‘নৌকা’র জন্য ভোট চাওয়া এবং তৃণমূলে জোটকে কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে জোটের শরিকরা।
জবাবে আমু তাদের আশ্বস্ত করেন, ১৪ দলীয় জোট অটুট থাকবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের নিয়েই পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও জোটের শরিকদের নিয়ে বৈঠক করে আসন ভাগাভাগি করা হবে।
সম্প্রতি ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু সাংবাদিকদের বলেন, শরিকদের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভ আছে, তবে এটি থাকবে না। কারণ ১৪ দলীয় জোট একটি আদর্শিক জোট। আমরা বসে নেই। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ বলেন, তৃণমূলকে শক্তিশালী করতে গ্রামে-পাড়া-মহল্লায় সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করতে হবে। মতভেদ ভুলে সবাইকে নিয়ে এখনই নির্বাচনী প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেন রওশন এরশাদ।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। সেটা এককভাবে নাকি জোটবদ্ধভাবে হবে, তা নির্বাচনকালীন পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। আমরা আমাদের নিজস্ব রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে যাচ্ছি। নির্বাচনের সময় আমরা জনগণের প্রত্যাশা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।
কী করলে জনগণের ভালো হবে সেদিক বিবেচনা করেই নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। জাতীয় পার্টি জনগণকে সুশাসন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। যদি মনে করতে পারি, নিজেরাই এককভাবে নির্বাচন করতে পারব তাহলে তাই করব। যদি আমাদের সেই শক্তি না থাকে তাহলে অন্য সিদ্ধান্ত নেব। এ ব্যাপারে দলের নেতাকর্মী ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, জাতীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সাংবাদিকদের বলেন, জোট আছে ঘুমন্ত অবস্থায়। নির্বাচন এলে হয়তো জাগ্রত হবে। সেই অর্থে জোটের কার্যকারিতা নেই। আমরা দিবস পালন করি। সম্প্রতি জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ধর্মভিত্তিক নতুন কোনো দলকে জোটে নেয়া হবে না।
তিনি বলেন, ১৪ দলীয় জোট থেকে আমরা নির্বাচন করব, সেটা তো প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই বলেছেন। আশা করি, জোটগতভাবে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। তবে বেশ কিছু ইসলামিক দলসহ আরও কিছু দল, যারা এখনো নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধিত নয়, তারা ১৪ দল অথবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদেরকে নতুন করে জোট গঠন করতে বলা হয়েছে। পরে ১৪ দলকে সম্প্রসারণ করে মহাজোট গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যাবে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (ইনু)-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ হিল কাইয়ুম ভোরের আকাশকে বলেন, ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ সম্পর্ক বিরাজমান। অটুট বন্ধনে আবদ্ধ শরিকরা। এমনকি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের যোগাযোগ এখন অনেক ভালো বলে জানান আব্দুল্লাহ হিল কাইয়ুম।
রাজপথে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একজোট হয়ে আন্দোলন করা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা তো ১৪ দলে আছি। নির্বাচনেও আমরা জোটবদ্ধ হয়ে অংশ নেব। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি একসঙ্গে আন্দোলনে থাকার জন্য ডাক দেন, তাহলে অবশ্যই আমরা তাতে অংশ নেব।
তিনি বলেন, ১৪ দলের পক্ষ থেকে যদি বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার কর্মসূচি দেয়া হয়, তাহলে করব।
ভবিষ্যতে রাজনৈতিক আন্দোলনে শরিকদের পাশে চাওয়া প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ভোরের আকাশকে বলেন, আদর্শগত দিক দিয়ে আমরা জোট গঠন করেছি। সেই গ্রাউন্ড এখনো বলবৎ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিগুলোকে একসঙ্গে মোকাবিলা করতেই আমরা জোটবদ্ধ হয়েছি। সাম্প্রদায়িক শক্তি বলি আর মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি বলি তারা এখনো সক্রিয়। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের জোটবদ্ধ লড়াই শেষ হয়ে যায়নি।
ভোরের আকাশ/নি