logo
আপডেট : ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০৯:০৩
বাড়তি সতর্কতায় আওয়ামী লীগ
নিখিল মানখিন

বাড়তি সতর্কতায় আওয়ামী লীগ

নিখিল মানখিন: রাজনৈতিক মাঠ দখলে রাখতে বিএনপিকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নানা কর্মসূচির মাধ্যমে মাঠে অবস্থান করার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, গত ২৮ অক্টোবরের ধাক্কা সামাল দিতে পারছে না বিএনপি। তাদের উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়া হবে না।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে আওয়ামী লীগ। বিদেশি কূটনৈতিক তৎপরতায় সফলতা পাচ্ছে দলটি। চীন ও রাশিয়ার পর ভারতের অব্যাহত পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সমর্থনে আওয়ামী লীগের মনোবল আরও শক্তিশালী হয়েছে। পাশাপাশি গত ২৮ অক্টোবরের সংঘর্ষ ও সহিংস ঘটনায় লাভবান হয়েছে আওয়ামী লীগ। সহিংসতা ও মানুষ হত্যার দায়ভার গিয়ে পড়েছে বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়ে। বিএনপির নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হচ্ছেন।

 

এভাবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক বিপাকে পড়েছে বিএনপি। নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে এসে অগোছালো হয়ে পড়েছে বিএনপি। দিকহীন হয়ে পড়েছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। নির্বাচনী প্রস্তুতিও নেই তাদের। সহিংসতা, হত্যাকান্ড এবং জ্বালাও-পোড়াও ঘটনার কারণে বিএনপির পক্ষে বিদেশিদের গলার সুরও নরম হয়ে গেছে। এমন অবস্থা থেকে বিএনপিকে উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে চায় না আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে ব্যাকফুটে রেখেই তফসিল ঘোষণার কাজ সম্পন্ন করতে চায় দলটি। তাই দলটির নেতাকর্মীদের মাঠে মারমুখো থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন দলটির হাইকমান্ড।

 

আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত টানা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। রাজপথ নিজেদের দখলে রেখে শক্তি দেখান ও বিরোধীদলগুলোর সরকার পতনের আন্দোলন মোকাবিলা করাই এর অন্যতম লক্ষ্য। এতদিন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর কর্মসূচির বিপরীতে পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে শান্তি সমাবেশ, মহাসমাবেশসহ বেশকিছু কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। তবে এবার আর কোনো পাল্টা কর্মসূচিতে যেতে চায় না দলটি। তাই নির্বাচন পর্যন্ত টানা কর্মসূচি পালনের বার্তা দেয়া হয়েছে।

 

আওয়ামী লীগ মনে করে, নির্বাচন পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায় বিরোধীদলগুলো। তাদের আন্দোলন মোকাবিলা করতে রাজপথে থাকার কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রতিদিনই শান্তি সমাবেশ পালন করা হবে। আগে রাজধানীকেন্দ্রিক এ ধরনের কর্মসূচির ওপর জোর দেয়া হলেও এবার দেশব্যাপী শান্তি সমাবেশের নামে রাজপথে নেতাকর্মীদের থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দলীয় এমপিদের নিজ নিজ এলাকায় অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।

 

নেতাকর্মীদের জানানো হয়েছে, দলের মধ্যে বিভেদ মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে থাকতে হবে। নিজেদের এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। সরকার পতনের অংশ হিসেবে ডাকা যেকোনো কর্মসূচি ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে।

 

নির্বাচন পর্যন্ত কর্মসূচি নিয়ে এরইমধ্যে দলের পক্ষ থেকে লিখিত নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস, নাশকতা ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে দেশব্যাপী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ কর্মসূচি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

 

গত ৩০ অক্টোবর সকালে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক যৌথসভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপি আওয়ামী লীগ ও সকল সহযোগী সংগঠনের জেলা/মহানগর ও উপজেলা/থানা/পৌর শাখাগুলোকে ব্যাপকভাবে কর্মসূচি পালনের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন।

 

এতে আরও বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত অপশক্তি তথাকথিত হরতাল, অবরোধ ও সমাবেশের নামে যাতে নাশকতামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এবং অপতৎপরতা করতে না পারে সেজন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী সমর্থকদের সর্বাত্মক সতর্ক অবস্থানে থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আহŸান জানানো যাচ্ছে। দলের এ নির্দেশনার অংশ হিসেবে এখন প্রতিদিনই রাজপথে অবস্থান করছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

 

আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটারদের আসতে বিএনপি নেতাকর্মীরা যেভাবে বাধা দিয়েছিলেন, এবার তাদের সেই সক্ষমতা নেই। এবার অবরোধে সহিংসতাও সেই সময়ের তুলনায় কম বলে মনে করছেন তারা। একে বিএনপির ‘শক্তি ক্ষয়’ হিসেবেই দেখতে চান তারা।

 

আওয়ামী লীগের নেতারা আরও জানান, ২০১৩ ও ২০১৫ সালে আন্দোলনে নেমে ব্যাপক সহিংসতার পরেও বিএনপির কর্মসূচি ভেঙে পড়ে। এবারও তাই হবে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পরদিন হরতাল এবং এক দিন বিরতি দিয়ে টানা যে অবরোধ বিএনপি, জামায়াত ও সমমনারা ডেকে আসছে, তা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। চতুর্থ দফা অবরোধের দিন ঢাকার সড়কে চলছে গাড়ি।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১১ সালে নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোটের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে জাতীয় সংসদ। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়ে আন্দোলনে যায় বিএনপি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি তা প্রতিহত করতে দেয়া হয় নানা কর্মসূচি। তবে ভোট ঠেকানো যায়নি। ওই বছরের ১২ জানুয়ারি শপথ নেয় নতুন সরকার। আর সেদিন থেকে অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করে বিএনপি।

 

দশম সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি দিনভর নাটকীয়তার পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবরোধের ডাক দেন। বেশ কয়েকদিন জোরাল কর্মসূচি চললেও এক পর্যায়ে তা শিথিল হয়ে আসে। পরে অবরোধের পাশাপাশি আসে হরতালের ঘোষণা। পরে ভেঙে পড়ে সেই কর্মসূচিও, স্বাভাবিক হয়ে আসে জীবনযাত্রা। এক পর্যায়ে কর্মসূচি প্রত্যাহার না করেই ওই বছরের ২৯ এপ্রিলের ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। বিরোধীদলের বর্জনের মুখে এর আগেও দেশে দুইবার নির্বাচন হয়। এরশাদ শাসনামলে ১৯৮৮ সালে এবং খালেদা জিয়ার আমলে ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির সেই ভোটের পর সরকার টিকতে পারেনি। তবে ২০১৪ সালের ভোটের পর আওয়ামী লীগ সরকার মেয়াদ পূরণ করে।

 

এরপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে ওই নির্বাচনে প্রথমে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি। পরে ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি নতুন জোট ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে তাতে অংশ নেয়। সে নির্বাচনে ভরাডুবির পর ‘আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার’ অভিযোগ আনে বিএনপি। ফিরে যায় তত্ত্বাবধায়ক দাবিতে।

 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির ‘গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার শক্তি ও সামর্থ্য নেই’ বলেই তারা বরাবরের মতো ‘অগ্নিসন্ত্রাসের পথ’ বেছে নিয়েছে।

 

বিএনপির চলমান কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, তারা যত হরতাল-অবরোধ দেবে জনগণের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে, দিনে দিনে তারা হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই আন্দোলনে দেশের মানুষের মধ্যে কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলেই অবরোধের মধ্যে গাড়ি চলছে, অফিস আদালত, দোকান পাট খোলা থাকেছে।

 

তফসিলের পরবর্তী সময়ে এসব কর্মসূচিতে নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, নির্বাচন হওয়ার ক্ষেত্রে এটা কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না।

 

ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, নির্বাচন হতে দেবে না, এই কথা বলে অবরোধের নামে কত কিছু করছে। কিন্তু এক সময় গতবারের মতো অবরোধ প্রত্যাহার না করেই ঘরে ফিরে যাবে। খালেদা জিয়া অবরোধ দিয়েছিল, সেই অবরোধ (২০১৫ সালে) এখনও ওঠে নাই। একই ধারায় জনগণ এবারের অবরোধও ভুলে যাবে। জনগণই তাদের ভুলিয়ে দেবে।

 

ভোরের আকাশ/নি