logo
আপডেট : ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০৯:৩৪
বিশ্লেষকদের অভিমত
অর্থনৈতিক সংকট ও মুদ্রা স্ফীতি ঠেকাতে প্রয়োজন অপচয় কমানো
মোতাহার হোসেন

অর্থনৈতিক সংকট ও মুদ্রা স্ফীতি ঠেকাতে প্রয়োজন অপচয় কমানো

মোতাহার হোসেন: বৈশ্বিক মহামারি করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল অবস্থায় নিপতিত। এই সংকট থেকে বাংলাদেশও বাইরে নয়। এই সংকট উত্তরণে বিশ্বের উন্নত, অনুন্নত, উন্নয়নশীল সব দেশই তাদের নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক কর্মসূচি, জীবন যাত্রার দৈনন্দিন কর্মসূচিতে কাটছাঁট করছে। এ ক্ষেত্রে জরুরি, অপরিহার্য্যতা বিবেচনায় নতুন করে সাজাচ্ছে, লাগাম টানা হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, অপ্রয়োজনীয় ক্রয়, বিলাসী পণ্যের ব্যবহার, আমদানি প্রভৃতি।

 

ঠিক একইভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ড করা হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় ও গুরুত্ব বিবেচনা করে। এ ক্ষেত্রে নতুন কোনো প্রকল্প নেয়া হচ্ছে না। বিশ্বের অপরাপর দেশের আদলে বাংলাদেশও চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্যয় সংকোচন, অপচয় কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সরকারের এই পদক্ষেপ সব ক্ষেত্রে যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ কারণে নিত্যপণ্যের মূল্য ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী এতে জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ এবং মানুষের সমস্যাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

 

দেশের অর্থনীতির বিশ্লেষক, অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকারকে গুরুত্ব, অগ্রাধিকার, আবশ্যকীয় বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি মুদ্রা স্ফীতি ও মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণে পুনর্বিন্যাস করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককের মুদ্রা নীতি। একই সঙ্গে সব ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন, বিলাসী, প্রসাধনী, পারফিউম, যানবাহন, ইলেকট্রোনিক্স পণ্য, ফল, ফলাদি, বিস্কুট, প্রসাধনী আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।

 

অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, বিশ্ব ব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করছে। এমনি অবস্থায় ব্যয় হ্রাস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সরকারি ব্যয় কমানো দরকার। একই সঙ্গে বিলাসী ও প্রসাধনীসামগ্রী আমদানি কমানো দরকার। একই সঙ্গে মানুষের জীবন, কর্মপ্রবাহ সচল রাখার সব পথ খোলা রাখতে হবে।

 

সূত্র জানায়, মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে সরকার কৌশলী ভ‚মিকা নেয়। এর মধ্যে সরকারি ব্যয়ে লাগাম টানা বা ব্যয় ও খরচ কমানোর নীতি ছিল অন্যতম। এই নীতির আওতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু নানা অজুহাতে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের এখনো ভ্রমণ অব্যাহত রয়েছে।

 

সরকারি প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের গাড়ি কেনাও বন্ধ রাখা হয়। সভা-সেমিনারের সম্মানীতে নিয়ন্ত্রণারোপ করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির নীতি অবলম্বন করা হয়। ডলার সংকট মোকাবিলায় আমদানি খাতকেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

 

এসব উদ্যোগের ফলে অবশ্য বিগত সময়ে সরকারি অর্থের কিছুটা সাশ্রয়ও ঘটে। তবে সরকারের মেয়াদের শেষদিকে এসে কেনাকাটার ওপর চাপ বেড়েছে অনেক বেশি। খাদ্যপণ্য আমদানিতেও রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যয় সংকোচন নীতির কারণ এখনো বিদ্যমান। সম্প্রতি নেয়া বেশ কিছু উদ্যোগ এ নীতির উল্টো।

 

সূত্র জানায়, নির্বাচন সামনে রেখে জেলা প্রশাসকসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য সম্প্রতি ২৬১টি নতুন গাড়ি কেনার উদ্যোগ শেষ সময়ে এসে বাতিল করা হয়। এতে প্রতিটি গাড়ি কিনতে খরচ হতো প্রায় দেড় কোটি টাকা। গাড়ি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে আসায় ব্যয় সাশ্রয় হলো প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।

 

সর্বশেষ গত বুধবারও ২৬টি দরপ্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। এসব প্রস্তাবের বিপরীতে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করবে সরকার। শুধু তাই নয়, খাদ্যপণ্য আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে আগের একই সময়ের তুলনায়। এদিকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ায় খাদ্য আমদানিতে সর্বোচ্চ ৮২ ভাগ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত। এ বছরের নভেম্বরেও একই চিত্রই ফুটে উঠেছে।

 

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, সরকার একদিকে সাশ্রয়ী হওয়ার কথা বলছে, অন্যদিকে এসব ব্যয় করছে। গাড়ি না কিনে অন্য উপায় অবলম্বন করা যেত। গাড়ি ভাড়া করেও বিকল্পভাবে কাজ চালানোর সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত কেনাকাটায় ডলারের ওপর চাপ বাড়াবে। একই সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতিরও চাপ।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চাল ছাড়া অন্যান্য খাদ্যপণ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েই চলেছে। ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে স্বল্পপণ্য আমদানির জন্য অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে বাজারে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। বর্তমানে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ, যা শিগগির কমার কোনো লক্ষণও নেই। বাধ্য হয়ে সংসারে খাবারের জোগান দিতে ব্যয় কমিয়ে এনেছে দেশের গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) দেশে ৬ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ মূল্যের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ কম। ওই অর্থবছরে (২০২১-২২) আমদানির পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। তবে ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে আমদানির জন্য গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত খরচ। ফলে গত এক দশকে খাদ্য আমদানি ব্যয় আগের তুলনায় আড়াই গুণ বেড়ে ৮০ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।

 

বিবিএস এর তথ্যমতে, দেশে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা অক্টোবরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা অক্টোবরে হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ।

 

সূত্র জানায়, ছাড়াও বিভিন্ন রকমের খাদ্যপণ্য যেমন- ডাল, তেল, আদা-রসুন, পেঁয়াজ, আলু, ডিম, জ্বালানি তেল, সার আমদানিতেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে সরকার, যা অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ মূলধনি যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও তা নিষ্পত্তি করার হার কমে গেছে অনেক বেশি। অর্থাৎ উৎপাদন খাত শ্লথ হয়ে রয়েছে। কিন্তু খাদ্যপণ্যের আমদানি বেড়ে গেছে।

 

ভোরের আকাশ/নি