নিখিল মানখিন: ডায়াবেটিস রোগীরা নতুন নতুন জটিলতায় ভুগছেন এবং যারা আক্রান্ত তাদের অর্ধেকই জানেন না যে তাদের ডায়াবেটিস রয়েছে। এমন তথ্য দিয়েছেন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ডায়াবেটিস এমন একটি শারীরিক অবস্থা যা একবার ধরা পড়লে সারা জীবনের জন্যে বয়ে বেড়াতে হয়। প্রতিদিন একবার পেটে ইনসুলিন ইনজেকশন, জীবনযাপনে পরিবর্তন ও নানারকম বিধিনিষেধ মেনে চলা সত্তে¡ও রোগটি সারা জীবন ধরে সাথী হয়ে থাকবে। কিন্তু অধিকাংশ রোগীর পক্ষে দৈনিক ন্যূনতম চিকিৎসাব্যয় বহন করা এবং নিয়মতান্ত্রিক যাপন করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
পাঁচ বছর আগে পূর্ব তেজতুরিবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. সাইফুল ইসলামের (৪৩) শরীরে ধরা পড়ে ডায়াবেটিস। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ২০১৯ সালের শুরুতে ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম। তার আগে কোনো ধরনের অসুখ বা শারীরিক সমস্যা ছিল না। হঠাৎ করে শুকিয়ে যেতে শুরু করলাম। কিন্তু খুব খিদে পেত, সারাক্ষণ গলা শুকিয়ে যেত। খুব একটা পাত্তা দেইনি। সহকর্মীদের একজন বলার পর পাড়ার দোকানে সুগার মেপে দেখি গ্লুকোজ লেভেল ২৫। ওই জানলাম যে আমার ডায়াবেটিস আছে।
তিনি আরও জানান, ধরা পড়ার অনেক আগেই আমার শরীরে বাসা বেঁধেছিল ডায়াবেটিস। প্রতিদিন নিজেই একবার করে পেটে ইনসুলিন ইনজেকশন পুশ করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার মত গরিব মানুষের পক্ষে নিয়মিত সবকিছু মেনে চলতে পারছি না বলে জানান মো. সাইফুল ইসলাম।
রাজধানীর মগবাজার এলাকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের মূল ফটকের সামনে চা বিক্রি করেন মো. ফারুক হোসেন (৩৯)। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ডায়াবেটিস নিয়ে খুব ঝামেলায় আছি। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে থাকার সময় শরীরে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। গত দুই বছর ধরে ডায়াবেটিসের সঙ্গে সংগ্রাম করছি। প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হয়। খেতে হয় ওষুধ। আমার মত গরিব মানুষের জন্য বাড়তি খরচ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চা বিক্রি করি। এভাবে শরীরের যত্ন নেয়া সম্ভব হয়ে উঠে না বলে জানান মো. ফারুক।
ঢাকার বারডেম হাসপাতালটি বাংলাদেশে ডায়াবেটিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। প্রতিদিন সকাল থেকে শত-শত মানুষ এখানে আসেন চিকিৎসার জন্য। প্রায় প্রতিমাসেই এখানে আসেন রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা মো. কাইয়ুম (৪৬)।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, বছর দুয়েক আগে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পর এখন নিয়ম করে দুই বেলা ওষুধ খেতে হয়। এখন প্রতিমাসে তার প্রায় দেড় হাজার টাকার মতো ওষুধ কিনতে হয় বলে জানান মো. কাইয়ুম।
পাশেই বসা ছিলেন আরেক ডায়াবেটিস রোগী গিয়াসউদ্দিন(৪৫)। তারা এসেছেন রাজধানীর নদ্দা এলাকা থেকে। তার স্ত্রী হালিমা খাতুন (৩৭) ভোরের আকাশকে জানান, তার স্বামী গিয়াসউদ্দিন গত আট বছর যাবত ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। প্রথম দুই বছর স্বামীর জন্য গড়ে এক হাজার টাকা খরচ হলেও, দিনের পর দিন সে খরচ বেড়েছে। এখন তার প্রতিমাসে খরচ হয় প্রায় নয় হাজার টাকার মতো। কারণ, ডায়াবেটিসের কারণে আরও নানাবিধ শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়েছে তার। বারডেম হাসপাতালে বসে হতাশা প্রকাশ করলেন । প্রতিমাসে স্বামীকে এখানে তিন-চারবার আনাই লাগে বলে জানান হালিমা খাতুন।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশনের হিসেব অনুযায়ী, দেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৭০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। একজন রোগীর যদি প্রতিমাসে গড়ে দুই হাজার টাকা খরচ হয়, তাহলে সে হিসেবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা বাবদ প্রতিমাসে বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে প্রতি মাসে ১৪ শত কোটি টাকা এবং প্রতি বছরে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম মহাসচিব এবং চিকিৎসক অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলছেন, সকল ডায়াবেটিক রোগীকে ট্যাবলেট খেতেই হয়। যেহেতু এর সঙ্গে অন্যান্য রোগ থাকে, এ ধরনের একটি রোগী কোনোমতেই প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার নিচে চলতে পারবে না। সচেতনতার মাধ্যমে যদি ডায়াবেটিসের বিস্তার কমানো সম্ভব না হয়, তাহলে এ রোগের জন্য আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হবে বলে জানান অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব।
নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ ৮০ শতাংশ রোগী: দেশের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, নীরব ঘাতক ডায়াবেটিসে আশঙ্কাজনক আক্রান্ত ও মারা যাওয়ার হার হ্রাসে সচেতনতামূলক কার্যক্রম দেশব্যাপী জোরালো করে তুলতে হবে।
ডায়াবেটিসের জটিলতায় সংঘটিত হৃদরোগ, কিডনি রোগ, চোখের রোগ, স্নায়ু রোগ, গর্ভকালীনসহ নানা দীর্ঘস্থায়ী জটিলতার শিকার হয়ে অকালে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে। আবার সতর্ক থাকলে ডায়াবেটিসের ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু একবার ডায়াবেটিস হয়ে গেলে আর এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। দেশে এ পর্যন্ত করোনা রোগীদের মৃত্যুর কোমরবিডিটি হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডায়াবেটিস। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২৬ লাখ আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা ৮৪ লাখ। এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এপিডেমিওলজিক্যাল ৩০ সপ্তাহে রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, করোনা রোগীদের মৃত্যুর কোমরবিডিটিগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস ছিল ৫৩ শতাংশ।
নানা রোগের কারণ ডায়াবেটিস: চিকিৎসকরা বলেন, ডায়াবেটিস অন্য আরো নানা ধরনের রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে চিকিৎসা ব্যয় বাড়তেই থাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, নীরব ঘাতক ডায়াবেটিস আজ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ডায়াবেটিস রোগটি এখন আর অপরিচিত কোনো রোগ নয়। দিনে দিনে এর প্রকোপের পাশাপাশি বৃদ্ধি পাচ্ছে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা এবং মৃত্যুঝুঁকিও।
অথচ একটু সচেতন হলেই এ রোগ থেকে এবং ডায়াবেটিস হলেও এ রোগের জটিলতাকে সহজেই রুখে দেয়া সম্ভব। ডায়াবেটিস জটিলতার কারণে মানুষের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, স্নায়ুরোগ, গর্ভকালীন জটিলতা ও কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় শরীরের অঙ্গ কেটেও ফেলতে হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী ডায়াবেটিসের জটিলতায় অনেক মানুষ প্রতিবছর অকাল মৃত্যুতে নিপতিত হচ্ছে। নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানোসহ সুশৃঙ্খল জীবন প্রণালি বজায় রাখলে ডায়াবেটিসের নীরব আঘাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব বলে জানান অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশে যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম। আরও ভয়াবহ হলো ২০৩০ ও ২০৪৫ সালে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যেটিকে প্রতিরোধ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে, কিন্তু একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে বাকি জীবন ডায়াবেটিস নিয়েই কাটাতে হবে এবং প্রহর গুনতে হবে যে, কখন ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতাগুলো দেখা দেয়। দেশে ডায়াবেটিস রোগীদের প্রায় ৭৫ শতাংশই ‘ ডায়াবেটিস ’ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
ভোরের আকাশ/নি