মো. জাহাঙ্গীর আলম ও ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার: মোমিনুল আলম একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকাতেই থাকেন। বেতন যা পান তাতে খেয়ে পরে তিন জনের সংসার চলে যায়। মাস কয়েক হলো তার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। প্রথমটায় যদিও একটু ভয় পেয়ে যান তিনি। পরে ডাক্তারের পরামর্শে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। সবকিছু ঠিকই চলছিল হঠাৎ একটা ছোট ভুলের কারণে চাকরি হারাতে হয় তাকে। মানষিক অস্থিরতার কারণে, নিয়মিত ঔষধ সেবন ও খদ্যাভ্যাস অপরিবর্তিত থাকার পরেও ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। বাড়তে থাকে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান।
বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস রোগের প্রতিকার, প্রতিরোধ ও সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয় যা আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত(১)। এটি মুলত একটি বিপাকীয় রোগ যা রক্তে শর্করার আধিক্য, ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া,অত্যধিক তৃষ্ণা (পলিডিপসিয়া), ঘনঘন প্রস্রাব (পলিইউরিয়া) ও ওজন হ্রাস, মিষ্টি খাবারের প্রতি আসক্তি, ক্লান্তি অনুভব ও ক্ষত নিরাময়ে বিলম্ব সহ বিভিন্ন উপসর্গে প্রকাশ পায়।
টাইপ-১ ও টাইপ-২ এই দুই ধরনের ডায়াবেটিসের মধ্যে মূলত টাইপ-২ ডায়াবেটিসই সবচেয়ে বেশি আলোচিত যা ডায়াবেটিস ম্যালাইটাস টাইপ-২ হিসবে পরিচিত। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং রক্তের প্রবাহে গ্লুকোজ জমা হতে শুরু করে। জিনগত কারণে অথবা অগ্ন্যাশয়ে ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়ে গেলেও এমন হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন (২)।
মোট ডায়াবেটিস রোগীর প্রায় নব্বই শতাংশই টাইপ-২ আর বাকি দশ শতাংশ প্রাথমিকভাবে টাইপ-১ ডায়াবেটিস ও গর্ভকালীন (জেস্টেশনাল) ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় শরীরের মোট ইনসুলিনের পরিমাণ কমে শর্করার সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়ে যায় আর টাইপ-২ ডায়াবেটিস কিছুটা প্রতিরোধযোগ্য। আইডিএফ এর একটি হিসাব অনুসারে, ২০২১ সালে আনুমানিক ৫৩৭ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিস রোগী ছিলেন এবং রোগী বৃদ্ধির এই ধারা বিদ্যমান থাকলে ২০৪৫ সালে এই সংখ্যা প্রায় ৭০০ মিলিয়নে পৌঁছাবে। বাংলাদেশে ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত যার অর্ধেকই নারী আবার আক্রান্ত মানুষদের ৫১ শতাংশ মানুষ জানেনই না যে তাদের ডায়াবেটিস আছে! আক্রান্ত নারী রোগীদের ২৬ শতাংশ গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে ভোগেন। আবার এদের ৬৮ শতাংশ রোগী পরবর্তীতে টাইপ -২ ডায়াবেটিসে ভোগেন (৩)!
গবেষণা বলছে যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ডায়াবেটিস পরিসেবার সাথে যুক্ত দীর্ঘস্থায়ী চাপ, কঠোর খাদ্যাভ্যাস এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিরীক্ষণসহ একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে বিষণ্নতা এবং উদ্বেগের মতো অবস্থার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাছাড়া সুস্থ্য না হবার ঝুঁকি, দীর্ঘদিন আক্রান্ত থাকার কষ্ট ,জীবন যাত্রার পরিবর্তন রোগীর মনোজগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
জামা নেটওয়ার্কের এক গবেষণা বলছে, ডায়াবেটিক রোগীর অন্যদের চেয়ে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি হারে বিষন্নতায় ভোগার ঝুঁকি রয়েছে(৪)। আমেরিকান ডায়াবেটিক সোসাইটি এইসব রোগীদের ক্ষেত্রে দিনের বেশিরভাগ সময় মন খারাপ থাকা ,যেসব কাজে আনন্দ পেত সেসব কাজে আনন্দ ও আগ্রহ কমে যাওয়া , ঘুম অস্বাভাবিক কমে বা বেড়ে যাওয়া , খাদ্যাভাসের পরিবর্তন, ওজন কমে যাওয়া ,কাজে ও চিন্তায় ধীরগতি হয়ে যাওয়া, নিজেকে নেতিবাচক চিন্তা করা বা নিজেকে সব কিছুতে দায়ী মনে করা, সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া, আত্মহত্যার চিন্তা, নিজেকে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে রাখা, অযোগ্য ও বোঝা মনে করাসহ নানাবিধ লক্ষণ খুঁজে পেয়েছেন (৫)। আর এই দ্বিমুখী লক্ষণগুলো রোগকে আরও প্রশমিত করে, কারণ এতে বিষণ্ণ মানুষটি দ্রুতই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বা বিষণ্ণ তার ফলে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষটি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
আবার যারা মানসিক রোগে ভুগছেন তাদের ডায়াবেটিস হলে রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করাও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। যাদের ইনসুলিন ইনজেকশন নিয়ে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা হয়, তাদের জটিল মানসিক রোগ চিকিৎসায় কিছুটা সমস্যা হতে পারে। মানসিক রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সিজোফ্রেনিয়া, যাতে রক্তের গ্লুকোজ বাড়ে। ফলে সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের ১৬% থেকে ২৫% ডায়াবেটিসে ভোগে(৬)।
পরিসংখ্যান বলছে যে, এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা বেশিরভাগই মানসিক অবসাদে ভোগেন। স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় অধিক সময় বিছানায় থাকতে হয় বলে এজাতীয় (সিজোফ্রেনিয়া) রোগীদের স্থুলতার পরিমাণ বেশি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মধ্যবয়সীদের দৈহিক স্থূলতা থাকলে স্মৃতি ভ্রষ্টতা (ডিমনেশিয়া ) হবার হার বাড়ে আর বেশি বয়সে ডিমনেশিয়া বাড়ে ডায়াবেটিসের কারণে(৭)।
অর্থাৎ অন্যান্য রোগগুলোর সাথে ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিসের সাথে অন্যান্য রোগ কিভাবে সম্পর্কিত তা সহজেই অনুমান করা যায়। এভাবে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে সামগ্রিক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বেড়ে যায়। আবার দুশ্চিন্তার কারণে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে একাধিক রোগ। ফলে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হতে পারে। কারণ হতাশা বা উদ্বেগের কারণে রোগীর শরীরে যে সব হরমোনের ক্ষরণ হয়, তা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
রোগের ব্যাপারে অতিরিক্ত চিন্তা, বিষণ্ণতা, হতাশাসহ রোগ সম্পর্কিত অপ্রতিরোধ্য অনুভূতিগুলি, যা ডায়াবেটিস যন্ত্রণা হিসাবে পরিচিত, রোগীকে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের দিকে ঠেলে দিতে পারে; এই জাতীয় রোগীরা নিজের ব্যপারে এতটায় অবসাদগ্রস্ত হয়যে এমনকি ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট এড়িয়ে যেতে পারলেও যেন তাদের শান্তি। অর্থাৎ, ধীরে ধীরে আক্রান্ত রোগী মানসিক রোগীতে পরিণত হয় (৮)।
ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানসিক রোগী বা সাধারণ ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতি একই। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ এই জাতীয় রোগীদের ক্ষেত্রে মনোযোগ সহকারে গভীরভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া,হাটা, ধ্যান বা মেডিটেশন করা, ইয়োগা বা যোগব্যায়াম করা, গান শোনা ইত্যাদি করতে পরামর্শ দিয়েছেন।
আর সাধারণ রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যায়াম, ‘স্ট্রেংথ ট্রেনিং’ বা মাংস পেশীর শক্তি বাড়ানো, অন্তত ৩০ মিনিট হাটা, পুষ্টিকর খবার খাওয়া, নিয়মিত রক্তের সুগার পরীক্ষা করানো, পা ও পায়ের পাতার পরিক্ষা করানো, ধূমপান ত্যাগ করা, মানসিক চাপমুক্ত থাকা, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষধ সেবন, ইনসুলিন গ্রহণ ইত্যাদি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন।
মো. জাহাঙ্গীর আলম
মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন অফিসার
এমিনেন্স এসোসিয়েট ফর সোশ্যাল ডেভোলাপমেন্ট
ও
ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার
সিইও
এমিনেন্স এসোসিয়েট ফর সোশ্যাল ডেভোলাপমেন্ট
ভোরের আকাশ/নি