logo
আপডেট : ১৮ নভেম্বর, ২০২৩ ০৯:০৩
বি প্ল্যানে বিএনপি
এম সাইফুল ইসলাম

বি প্ল্যানে বিএনপি

এম সাইফুল ইসলাম: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কৌশলে বেশ পরিবর্তন এনেছে বিএনপি। দলটির এক সময়ের ‘শর্টটার্ম’ আন্দোলনের পরিবর্তে এখন বেশ কিছু দিন মাঠে থাকতে হবে বলে সর্বস্তরে বার্তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া সমমনা দলগুলোকে নিয়ে ভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে সরে এসে একছাতার তলে কর্মসূচি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পূর্বের কৌশল পাল্টে গা-ঢাকা দেয়া নেতাদেরকে মাঠে নামার নির্দেশনাও দিয়েছে বিএনপি।

 

পরিবর্তিত সময়ে দলটি আগের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পেরে এখন দ্বিতীয় ধাপ বা ‘বি প্ল্যানে’ এগোচ্ছে। আন্দোলনের পাশাপাশি কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মাঠে থাকতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিএনপি। ক্ষমতাসীনদের কৌশল মোকাবিলায় আগামীতে পরিকল্পনায় আরো পরিবর্তন আনতে পারে দলটি। বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা বলছেন, তারা চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর শর্টটার্ম আন্দোলন করবেন। কিন্তু সেটি না হওয়ায় তারা এখন ভিন্ন পরিকল্পনায় এগোচ্ছেন। সামনে পরিকল্পনায় আরো পরিবর্তন আসতে পারে।

 

জানা গেছে, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পন্ড ও সংঘর্ষের পর অনেকটাই এলোমেলো বিএনপি। শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ সফল করার পর শর্টটার্মের জন্য শক্ত কর্মসূচিতে যাওয়ার যে পরিকল্পনা ছিল দলটির তার বাস্তব চিত্র উল্টো। মহাসমাবেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। পুলিশ কনস্টেবল নিহত হওয়ার ঘটনায় দলটির নেতাকর্মীদের নামে একেরপর এক মামলা হয়। দীর্ঘদিন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হলেও সমাবেশ পন্ড হওয়ার পর বিএনপি হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে রয়েছে। মহাসমাবেশ পন্ড হওয়ার পর গত ২৯ অক্টোবর দলটির পক্ষ থেকে হরতালের ডাক দেয়া হয়।

 

এরমধ্যে দলটির মহাসচিব থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ নেতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন। সারা দেশে ১০ হাজারের বেশি বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে দাবি দলটির। চলমান অবস্থায় দল বা অঙ্গসংগঠনের জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতি হাইকমান্ডের নির্দেশনা ছিল সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার। বিএনপি বা অঙ্গসংগঠনের নেতারা বেশিরভাগ এখন নিম্ন সারির নেতা বা কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বেশিরভাগ স্থানে কর্মসূচি পালিত হয়েছে অনেকটাই ঢিলেঢালা। তবে, গত ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।

 

জানা গেছে, দলটির কৌশল ছিল তফসিলের আগে গ্রেপ্তার এড়ানোর। তাই তফসিল ঘোষণার পরপরই গা-ঢাকা দেয়া নেতারা মাঠে নামতে শুরু করেছেন। তফসিলের পর দলটির হাইকমান্ড সব নেতাকর্মীকে মাঠে নামার নির্দেশনা দিয়েছেন। দলটির একাধিক সূত্র বলছে- তফসিলের দিন রাতেই বিএনপির হাইকমান্ড বিভিন্ন ইউনিটের নেতাদের মাঠে নামার নির্দেশনা দিয়েছেন। এখন প্রয়োজনে মাঠে থেকেই গ্রেপ্তার হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। এতোদিন ঢিমেতালে চললেও তফসিলে পর নেতাকর্মীদের মাঠে নামতে দেখা গেছে। আগামীকাল থেকে যে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল রয়েছে সেটি সর্বোচ্চভাবে মাঠে থাকতেও নির্দেশনা হাইকমান্ডের।

 

বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতারা বলছেন, একসময় তাদের পরিকল্পনা ছিল তার অল্পদিনে শক্ত কর্মসূচি দিয়ে দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করবেন। কিন্তু প্ল্যান আর এখন কাজে আসছে না। কারণ, নানা চাপ উপেক্ষা করে ইতোমধ্যে তফসিল ঘোষিত হয়েছে। সরকার নির্বাচনের পথে। তাই চলমান আন্দোলনে বেশ লম্বা সময়ে তাদেরকে মাঠে থাকতে হতে পারে। সেভাবেই নির্দেশনা রয়েছে তাদের কাছে। তফসিলের পরও সমঝোতা হতে পারে বলে তাদের অনেকের মত। আবার অনেকে বিপরীত কথা বলছেন। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ কোনো সমঝোতায় যেতে চাইবে না। আবার আন্দোলনকারীরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠ ছাড়বেন না।

 

বিএনপির সমমনা একটি দলের নেতা ভোরের আকাশকে বলেছেন, তফসিলের আগে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনাল্ড লু সংলাপের আহব্বান জানিয়ে বড় তিন দলকে যে চিঠি দিয়েছেন সেটি মার্কিনসহ পশ্চিমাদের স্পষ্ট বার্তা যে, তারা বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন চান। পশ্চিমাদের চাপ উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ভোট করতে পারে কিনা সেটি নিয়ে আশঙ্কা আছে।

 

তার মতে, অর্থনৈতিকসহ নানা নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এটি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখার সব কৌশল আছে বিএনপির। আর দেশের অভ্যন্তরে চাপ সৃষ্টির জন্য তারা কর্মসূচি লম্বা করতে চান। দেশে সবকিছুর যে স্বাভাবিকতা আছে সেটি ব্যাহত করে সরকারকে চাপে ফেলতেই তাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলেও মনে করছেন বিএনপি ও সমমনা দলের মধ্যম ও নিম্ন সারির নেতাদের ধারণা।

 

এদিকে, কর্মসূচি গ্রহণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জেলের বাইরে থাকা নেতারা দলটির কেন্দ্রীয়, জেলা-উপজেলা এমনকি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের নেতাদের পরামর্শ নিচ্ছেন। তাদেরকে মাঠে থাকার নানা কৌশলও দিচ্ছেন। কর্মসূচি গ্রহণ ও তা জোরালভাবে বাস্তবায়নে বিএনপির হাইকমান্ড সমমনাদের পরাশর্ম গ্রহণ করছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতসহ সমমনাদের আলোচনায় উঠে এসেছে একসঙ্গে অর্থাৎ একছাতার তলে এসে আন্দোলনের তাগিদ। বিষয়টি নিয়ে বেশিরভাগ দল এখন একমতে পৌঁছেছে।

 

তবে, কয়েকটি বামদল জামায়াত নিয়ে একসঙ্গে আন্দোলনের বিরোধীতা করলেও তা হালে পানি পায়নি। ইসিসহ কয়েকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ঘেরাও কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হলেও তাতে অনেকের দ্বিমত রয়েছে। তাই আপাতত হরতাল-অবরোধে থাকছে বিএনপি ও সমমনারা।

 

তফসিল প্রত্যাখ্যান করে আগামীকাল রোববার ও সোমবার ৪৮ ঘণ্টার হারতাল কর্মসূচি রয়েছে সরকারবিরোধীদের। জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, সমমনা জোট, এলডিপি ও গণঅধিকার পরিষদসহ যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের সর্বোচ্চভাবে বিএনপির হাইকমান্ড নির্দেশনা দিয়েছে জোরালভাবে কর্মসূচি পালনের। পাশাপাশি চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে নিজস্ব কায়দায় হলেও কর্মসূচি পালনে কাজ করছেন বিএনপির কয়েকজন নেতা।

 

এছাড়া দু’দিনের হরতালের পর আরো কয়েকদিন একই ধরণের কর্মসূচি পালনের পর একপর্যায়ে ‘অসহযোগ আন্দোলন’র ঘোষণা দিতেও কাজ চলছে বলে জানা গেছে। চলমান হরতাল-অবরোধ জেলা ও উপজেলাও শক্তভাবে পালনে সারা দেশ থেকে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করতে সব ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছে বিএনপি।

 

ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মতিউর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, দলের নেতাকর্মীরা শত বাধা উপেক্ষা করে হাইকমান্ডের নির্দেশনায় মাঠে আছেন। কোনোভাবেই তারা মাঠ ছেড়ে যাবে না। আগামীতে আন্দোলন আরও বেগমান হবে।

 

বিএনপির যুগপথের সমমনা গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারকে দাবি মানতে যা কিছু করা দরকার দেশের মানুষ তাই করবে। গ্রেপ্তার করে আন্দোলন দমানো যাবে বলে যারা ভাবছেন তা বোকার স্বর্গরাজ্যে আছেন বলেও মনে করেন তিনি। আরো বেশ কিছুদিন মাঠে থাকা লাগবে ধরে নিয়েই তারা মাঠে আছেন। রাজনৈতিক দল সবসময় কয়েকটি ছক বা পরিকল্পনা নিয়ে মাঠ থাকে।

 

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম ভোরের আকাশকে বলেন, কোনো স্বৈরাচারের সহজে পতন হয় না। তাই মাঠে বেশছিুুদিন থাকা লাগতে পারে। সেভাবেই তাদের প্রস্তুতি রয়েছে। তিনি বলেন, কোনো ছলচাতুরি করে এবার পার পাবে না আওয়ামী লীগ সরকার। দেশের পাশাপাশি বাইরের গণতান্ত্রিক সব শক্তি এখন আওয়ামী লীগের বিপক্ষে। সরকার যে কৌশল নেবে আন্দোলনকারীরা কৌশলে পরিবর্তন আনবে।

 

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, পুলিশি নির্মম নির্যাতন উপেক্ষা করে দল আন্দোলনে আছে। পাতানো নির্বাচন দেশের মানুষ মেনে নেবে না। বিজয় হওয়া পর্যন্ত নানা কৌশলে মাঠে থাকবেন নেতাকর্মীরা। দেশের মানুষ চলমান আন্দোলনে স্বতঃস্ফর্ত সমর্থন দিয়েছে বলে দাবি তার।

 

ভোরের আকাশ/নি