logo
আপডেট : ২২ নভেম্বর, ২০২৩ ০৭:১৯
প্রতারণার টাকায় দুবাইয়ে আলিসানি জীবন
ইমরান খান

প্রতারণার টাকায় দুবাইয়ে আলিসানি জীবন

ইমরান খান: বিদেশ পাঠানোর নাম করে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে দুবাই আলিসানি জীবনযাপন করছে নোয়াখালির আনোয়ার হোসেন সেলিম নামের এক প্রতারক। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। একই সাথে প্রতারক দেশের বাইরে থাকায় দেশে আসামাত্র তাকে গ্রেপ্তারকরতে ইমিগ্রেশন বিভাগকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগ ও ভুক্তভোগীদের দেয়া অভিযোগের প্রেক্ষিতে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

 

টালির ভিসার নামে ৩২ লাখ টাকা দেয়া তিন ভুক্তভোগী নোয়াখালীর মাইজদি এলাকার আশরাফ জামান অপু, কাওসার এবং জসিম। আদালতে দায়ের করা অভিযোগে প্রতারিত এই তিন যুবকের অভিযোগ, আনোয়ার হোসেন সেলিম নামের ওই যুবকের গ্রামের বাড়িও নোয়াখালী। সেই সুবাদে পরিচয় হয়। সে রাজধানীর পুরানা পল্টনের আল জাবির ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানেরও মালিক বলে তাদের জানায়।

 

তারা অভিযোগ করে বলেন, তাদের সঙ্গে ইটালি যাওয়ার বিষয়ে কথা হয়। সে খরচ বাবদ অপুর নিকট থেকে ১৪ লাখ, কাউসারের নিকট থেকে ১০ লাখ এবং জসিমের নিকট থেকে ৮ লাখ টাকা নেয়। কিন্তু যাওয়ার জন্য কোন প্রকার ভিসা বা অন্যান্য কোন প্রসেস-ই করেনি। পরবর্তীতে তারা ঢাকায় এসে যোগাযোগ করে দেখে সে যে ঠিকানা দিয়েছিল সেই ঠিকানাই আর নাই।

 

প্রতারিত যুবকরা জানান, পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তাদের মতনআরো অনেক লোকের কাছ থেকে সে টাকা আত্নসাৎ করে দুবাই চলে গেছে।

 

তারা জানান, ‘আমরা অনেক স্বপ্ন নিয়ে ইটালি যাওয়ার আশায় জমি ভিটা বিক্রি করে তাকে টাকাগুলো দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের এখন সব স্বপ্ন শেষ। আমরা প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। জানিনা আমরা কি করবো। তবে এই প্রতারকের শাস্তি আমরা চাই। এজন্য আমরা আদালতের স্মরনাপন্ন হয়েছি। আদালত থেকে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছে। সে যেহেতু দুবাই থাকে সেহেতু ইমিগ্রেশন বিভাগকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে।

 

এদের মতো আরো অন্তত অর্ধশত ব্যক্তির নিকট থেকে বিপুল অংকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন সেলিম। সৌদি যাওয়ার জন্য ৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন কুমিল্লার আরিফ। তিনিও প্রতারিত হয়েছেন।

 

আরিফ বলেন, অনেক কস্ট করে টাকাগুলো সেলিমকে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সঙ্গে সে প্রতারণা করেছে। বর্তমানে সে প্রতারনার টাকায় দুবাই গিয়ে আরাম আয়াশে দিন কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় পল্টন থানায় তিনি অভিযোগ দায়ের করেছি।

 

সিরাজগঞ্জের প্রতারিত তিন যুবক কামরুল ইসলাম, মনির হোসেন ও সুলতান আহমদ। তারা বলেন, ইটালির জন্য ৩০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে মাদারীপুরের দুইজনকে আরো ২০ লাখ দিতে দেখেছেন। এভাবে সে প্রায় ৫০ জনেরও বেশি লোকের নিকট থেকে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা করে ইতালি, সৌদি দুবাই যাওয়ার নাম করে টাকা নিয়েছেন। কিন্তু কাউকে পাঠাতে পারেননি। উল্টো সে টাকাগুলো আত্মসাৎ করে দুবাই পালিয়ে গেছে। এখন আমরা উপায়হীন হয়ে আদালতে গেছি।

 

এদিকে পল্টনের পাশাপাশি গুলশান ও বনানী থানাতেও প্রতারক আনোয়ার হোসেন সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। বনানী থানায় অভিযোগ করেন শরিয়তপুরের ভুক্তভোগী ইউসুফ হোসেন। আর গুলশান থানায় অভিযোগ করেন লক্ষিপুরের আসলাম।

 

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, জার্মানি যাওয়ার জন্য দুই ধাপে ১৫ লাখ করে ৩০ লাখ টাকা দেন তারা । কিন্তু তিনি টাকা নেয়ার পর আর কোন যোগাযোগ রাখেননি।

 

বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান অভিযোগ দায়েরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ওই প্রতারক বর্তমানে দেশের বাইরে আছে। অনেক লোকের টাকা আত্মসাৎ করে গোপনে দেশ ছেড়ে চলে গেছে।

 

গুলশান থানার ওসি ফরমান আলী বলেন, সেলিম একজন বড় মাপের প্রতারক। সে মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। তিনি বলেন, তার প্রতারণার ঘটনায় থানায় কয়েকটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। কিন্তু দেশের বাইরে থাকায় তাকে গ্রেপ্তারকরা যায়নি।

 

গুলশান থানায় অভিযোগ দায়ের করা শাওন ইসলাম নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, তার নিকট আত্নীয় দুইজনের জন্য ১৮ লাখ দিয়েছিলেন। তাদের ইটালি নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে তার কোন খোঁজ পাননি। গুলশান ১ এ ডিসিসি মার্কেটের বিপরীতে তার একটি অফিস ছিল। কিছুদিন পর সেই অফিস ও নাই, আর কোন খোঁজও পাওয়া যায়নি।

 

তিনি বলেন, বর্তমানে তিনি খুবই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। এ কারনে থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। সেলিম যেহেতু দেশে নেই এজন্য কিছুই করতেও পারছেন না।

 

মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার হায়াতুল ইসলাম বলেন, সেলিম নামের এই প্রতারকের দারা বেশকিছু যুবক প্রতারনার শিকার। সে পল্টন ও গুলশান এলাকা থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

 

তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করেছেন। আদালত ওয়ারেন্ট ইস্যুও করেছেন। এছাড়া বিদেশ থেকে আসামাত্রই তাকে যেন গ্রেপ্তারকরা হয় সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছেন। সে দেশে না আসা পর্যন্ত করার আর কিছুই নাই বলেও জানান পুলিশের এ উর্ধতন কর্মকর্তা।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারির দিকে পুরানা পল্টনের জামান টাওয়ারে এক মাসের কম সময়ে একটি রুম নিয়ে অফিস বানিয়েছিলেন সেলিম। কিন্তু পরবর্তীতে তার আর কোন খোঁজ নাই। সেখানকার এক ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন পরে সে গুলশান বনানীর দিকে ছিল। তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন তার অফিস থাকলেও কখন আসতো আর কখন যেত তেমন চোখে পড়তোনা।

 

জানা গেছে, সেলিম চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ থেকে দুবাই চলে যান। আর সেখানে গিয়ে গাড়ি ও রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করছেন। প্রতারণার কোটি কোটি টাকা দিয়ে এক প্রকার আলিসানি জীবন যাপন করছেন। সেখানকার ডান্সবারসহ ফুর্তি করা সব জায়গাতেই তাকে দেখা যায় বলে বিভিন্ন মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

 

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানজিলা ইসলাম বলেন, আদালতের নির্দেশনা তারা পেয়েছেন। এই প্রতারকের বিরুদ্ধে যেহেতু গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছে সেহেতু দেশে আসামাত্রই সে গ্রেপ্তার হবে।