logo
আপডেট : ২৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০৯:৩৪
থামছে না বন্যপ্রাণী পাচার: জড়িত ১১ জনের সিন্ডিকেট
মো. ইব্রাহিম শেখ, চট্টগ্রাম

থামছে না বন্যপ্রাণী পাচার: জড়িত ১১ জনের সিন্ডিকেট

৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের শাহ আমানত সেতু এলাকায় আটক হনুমান

দুর্লভ বন্যপ্রাণী পাচার হচ্ছে বান্দরবান-কক্সবাজারের গহীন অরণ্য থেকে। বান্দরবান-চট্টগ্রাম এবং ঢাকার ১১ জন মিলে নিয়ন্ত্রণ করছে দুর্লভ প্রাণী পাচারের এ সিন্ডিকেট।

 

সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাকালিয়া থানা এলাকা থেকে একটি ভল্লুক উদ্ধার করে চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় ইমরান হোসেন নামে এক যুবককে। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইমরান বন্যপ্রাণী পাচারে জড়িত ১১ ব্যক্তির নাম প্রকাশ করে। ইমরান কুমিল্লার দেবীদ্বার থানার বালুঘাট গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে।

 

পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইমরান জানিয়েছেন, চন্দনাইশের শঙ্খ নদী তীরবর্তী ধোপাছড়ি, বান্দরবানের আলিকদম থেকে বন্যপ্রাণী পাচার হয় ঢাকায়। ঢাকা থেকে এসব প্রাণী পাচার হয় দেশের বাইরে। আর প্রাণী পাচারের রীতিমত সিন্ডিকেট রয়েছে। ঢাকার বসুন্ধরা এলাকার হদিস নামে এক ব্যক্তি মূলত বন্যপ্রাণী পাচার সিন্ডিকেটের মূল হোতা। চন্দনাইশের ধোপাছড়িতে আরিফ মিয়া ওরফে সাইফুল, আবদুল আলীম ও নাসির উদ্দিন, বান্দরবানের আলিকদম বাজারে উত্তম, বিকাশ, মোবারক ও বাবুল কক্সবাজারের চাকরিয়ায় দীপক, চট্টগ্রাম মহানগরীতে হেলাল ও খুলনার সোনাডাঙ্গা গ্রামের জাহিদ মুলত এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন।

 

সর্বশেষ গত শুক্রবার (৩ নভেম্বর) বিকেলে নগরীর বাকলিয়া থানার শাহ আমানত সেতু এলাকায় একটি সিএনজি ট্যাক্সিতে তল্লাশি করে পাঁচটি মুখপোড়া হনুমানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার তিনজন হলেন মো. সেলিম (৫৩), সালাউদ্দিন কাদের (৩৫) ও নুরুল কবির (৩১)। হনুমান তিনটিও আনা হয়েছিল বাকলিয়ার ইমরানের কাছে। আগের দিন উদ্ধার করা হয়েছিল মহাবিপন্ন প্রজাতির দুটি গোরখোদক।

 

নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা (ইন্টারপোল) বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সারা বিশ্বে গোয়েন্দা নজরদারী পরিচালনা করছে। সে ধারাবাহিকতায় পুলিশের হেডকোয়াটার্সের তথ্য অনুযায়ী বাকলিয়া থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে পাঁচটি মুখপোড়া হনুমানসহ তিন প্রাণী পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে।

 

এর আগে গত ২ নভেম্বর মহাবিপন্ন দুটি গোরখাদকসহ এ চক্রের আরও দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্য থেকে এসব প্রাণী ধরে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত ও নৌ-পথ দিয়ে প্রাণীগুলো ইউরোপ-আমেরিকা পাঠিয়ে দেয়া হয়। চট্টগ্রামকে তারা একটি রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।

 

সিএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাচারকারীরা জানিয়েছে কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে হনুমান পাঁচটি চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। এরপর শাহ আমানত সেতু পার হয়ে বাকলিয়ায় ইমরান নামে এক ব্যক্তির হাতে দেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য তাদের ৭০ হাজার টাকা দেয়ার কথা হয়েছিল। সেগুলো ভারতের বর্ডারে নিয়ে এরপর বিদেশে পাচারের পরিকল্পনা ছিল তাদের।

 

গত ছয়মাসে চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ছয়টি রাজ ধনেশ, লজ্জাবতী বান, মেছো বিড়াল, সজারু, পেঁচা, উল্লুক, বনমোরগ ও চশমা পরা হনুমান উদ্ধার করা হয় পাচারকারীর হাত থেকে। বন্যপ্রাণী পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার প্রত্যেকে জানিয়েছে, আলিকদম থেকে এসব প্রাণী প্রায় সময় পাচার হচ্ছে। বান্দরবানের আলি কদমের গহীন অরণ্য থেকে এবং চন্দনাইশের ধোপাছড়ির পাহাড়ি এলাকা থেকে দুর্লভ বন্যপ্রাণী পাচার হচ্ছে।

 

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অভিযান) সুদীপ্ত সরকার জানান, আলিকদম থেকে চকরিয়া-বাঁশখালী, থনাচি-বান্দরবান-কাপ্তাই-রাঙ্গুনিয়া-রাউজান, চকরিয়া-চট্টগ্রাম এ তিন রুটে বিপন্ন প্রাণী পাচার হচ্ছে ঢাকায়। পরে সীমান্ত পার হয়ে এসব প্রাণী যাচ্ছে পার্শ্ববতী দেশে।

 

চলতি বছরের ২৫ মে বাঁশখালীর গুনাগরি বাজারে একটি সিএনজি চালিত ট্যাক্সি থেকে চারটি রাজ ধনেশের বাচ্চা উদ্ধার করেছিল বাঁশখালী থানা পুলিশ। ওই সময় সিএনজিচালক সেলিম জানিয়েছিল এর আগেও তিনি চার পাঁচ জোড়া ধনেশ একই পথে পাচার করেছে। সেলিমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ধনেশ নিতে ঢাকা থেকে আসা মিজানুর রহমান নামে একজন প্রাইভেটকার চালককে আটক করা হয়। দুইজনকে ছয়মাসের কারাদ- দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

 

গত বছরের ৮ অক্টোবর রাতে লোহাগাড়ার চুনতি রেঞ্জ অফিসের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে বিলুপ্তপ্রায় একটি উল্লুক উদ্ধার করা হয়। এ সময় দুই পাচারকারীকে আটক করা হয়। দন্ডিত ব্যক্তিরা হলেন কুমিল্লা দেবিদ্বার ফতেয়াবাদ এলাকার জলিলের ছেলে মুবিন (৩০) ও দাউদকান্দির পেন্নাই এলাকার মজিদের ছেলে মাজহারুল হক। উল্লুকটি আলিকদম থেকে তারা ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিল।

 

গত ২৭ অক্টোবর আমিরাবাদ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিপন্ন প্রজাতির একটি চিতা বিড়াল, তিন মেছো বিড়াল ও একটি বন মোরগ উদ্ধার করে লোহাগাড়া থানা পুলিশ। এ সময় এমরান ও আবদুল আলীম নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। ১০ নভেম্বর কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাসে তল্লাশি করে একটি সজারু, একটি পেঁচা ও দুটি লজ্জাবতী বানর উদ্ধার করে। আটক করা হয় এরশাদ নামে এক যুবককে।

 

ভোরের আকাশ/নি