নিখিল মানখিন: বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়া ঠেকাতে ‘ডামি (স্বতন্ত্র)’ প্রার্থী রাখার অনুমতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমন ঘোষণায় প্রশান্তিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত কয়েক হাজার প্রার্থী। এমন সিদ্ধান্তে মনোনয়ন পেয়েও চরম চাপে পড়েছে কম জনপ্রিয় অনেক নৌকার মাঝি।
ইতোমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা। চলছে শোডাউন। স্বতন্ত্রপ্রার্থী না হওয়া অনেক মনোনয়ন প্রত্যাশি আওয়ামী লীগ নেতা ডামি প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন ঘোষণা দিয়ে নৌকাপ্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। আর নৌকাপ্রার্থী এবং স্বতন্ত্রপ্রার্থী-উভয় প্রার্থীদের মুখ থেকে বের হচ্ছে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়েছে রোববার। দুটি আসন ফাঁকা রেখে ২৯৮ আসনে প্রার্থী দিয়েছে তারা। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছিল তিন হাজার ৩৬২টি। যারা মনোনয়ন পাননি তাদেরও সুযোগ থাকছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার। গত রোববার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারীদের সঙ্গে গণভবনে মতবিনিময় করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ পাস করে আসতে পারবেন না। প্রত্যেক প্রার্থীকেই একজন করে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখতে হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী অনুমোদন দেয়ার বিষয়টিকে দলীয় কৌশল বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
সোমবার শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলন দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডা. মিলন চত্বরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি বলেন, দলের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে দলের অবস্থান অনুযায়ী ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে দলীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেন এবং সিদ্ধান্ত দেন। নতুন নতুন সময়ে নতুন নতুন স্ট্র্যাটেজিও দলকে গ্রহণ করতে হয়। এসময় যে কৌশল দরকার আমাদের, আমাদের নেত্রী সেই কৌশলই ঠিক করেছেন এবং গতকাল তার বক্তব্যে প্রকাশ করেছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েও পরপর দুদিন চেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারেননি জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, কাজেই এ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ কতটা, সেটা এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন সাধারণ সম্পাদক।
দলীয় সূত্র জানায়, চলতি বছর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন ৩ হাজার ৩৬২ জন। তবে প্রতিটি নির্বাচনেই নতুন প্রার্থীদের প্রাধান্য দেয় দলটি। সর্বশেষ গত ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তার আগের সংসদের ৫৬ জন এমপি দলীয় মনোনয়ন পাননি। আবার ২০১৪ সালের নির্বাচনে তার আগের সংসদের ৪৯ জনকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। এবারে মনোনয়নের ক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততাকে গুরুত্ব দিচ্ছে ক্ষমতাসীনরা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আট বিভাগের মধ্যে ঢাকায় সর্বোচ্চ ৭৩০টি ফরম বিক্রি হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের আসন ৫৮টি। ফরম বিক্রি হয়েছে ৬৫৯টি। খুলনা বিভাগে ৩৬টি আসনের বিপরীতে মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৪১৬টি। রাজশাহী বিভাগের ৩৯টি আসনের বিপরীতে বিক্রি হয়েছে ৪০৯টি। রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনের বিপরীতে বিক্রি হয়েছে ৩০২টি। ময়মনসিংহ বিভাগের আসন ২৪টি। মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ২৯৫টি। বরিশাল বিভাগের আসন ২১টি। বিক্রি হয়েছে ২৫৮টি। সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের বিপরীতে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ১৭২টি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকার সুযোগ দেয়ায় মোট দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তদের তিন ভাগের এক ভাগ নৌকার মাঝি তীব্র চাপে থাকবে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল সমস্যা নিরসন করতে পারেননি দলীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গত ১৫ বছরে সৃষ্ট কোন্দল স্থায়ী ও প্রকট রূপ নিয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিলেন বর্তমান অনেক সংসদ সদস্য, যারা এবারও মনোনয়ন পেয়েছেন।
অনেক স্বেচ্ছাচার সংসদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। সরকার ও দল একাকার হওয়ায় বেড়েছে জটিলতা। কোন্দলের শিকড় অনেক গভীরে বিস্তার লাভ করেছে। একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে এক ঘরে হয়ে পড়েছেন অনেক সংসদ সদস্য। হয়ে পড়েন জনবিচ্ছিন্ন। জড়িয়ে পড়েন একের পর এক কেলেঙ্কারিতে।
অনেক নির্বাচনী এলাকায় ত্যাগী, দক্ষ ও স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন ইমেজের নেতারা দলে জায়গা না পেয়ে হতাশ হয়ে ওই ধরনের সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে অবন্থান নিয়েছেন। অধিকাংশ এলাকায় আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনে একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহার করে থাকেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন ছাড়া কমিটিতে স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
এক্ষেত্রে যোগ্যতার বিষয়টি বিচার-বিবেচনায় আনা হয়নি। আওয়ামী লীগের বিভাগীয় টিম এবং জেলা নেতারাও অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন। আর পদবঞ্চিত যোগ্য নেতারা তৈরি করেন পৃথক দলীয় বলয়। আর এই সব দলীয় বলয়গুলোই আজ নৌকার মাঝিদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ‘মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীর পাশাপাশি ডামি ক্যান্ডিডেটও (বিকল্প প্রার্থী) রাখতে বলেছেন (শেখ হাসিনা), যেন কারও মনোনয়ন বাতিল বা প্রত্যাহার করলে যেন ডামি ক্যান্ডিডেট নির্বাচন করতে পারে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘নেত্রী বিকল্প প্রার্থী রাখতে বলেছেন নির্বাচনে যাতে কেউ কোনো ধরনের অনিয়ম করতে না পারে। ভোটারের উপস্থিতি যাতে বাড়ে, সে জন্যও কাজ করতে বলেছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘গণমাধমে জেনেছি-আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন এবার কেউ চাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থীও হতে পারবে। মানে এরকমও হতে পারে যারা বাদ পড়লেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করবেন। এই বিষয়টি দলের প্রার্থীদের জন্য ভালো।
ভোরের আকাশ/নি