সিলেট ব্যুরো: সিলেটের পাহাড়-টিলাকে কেন্দ্র করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে হাজারো মানুষ। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম ও বিভিন্ন সময় পাহাড় ধ্বস শুরু হলে এসব বসবাসকারীকে নিয়ে বাড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ভারী বৃষ্টি ও টিলা কাটার ফলে ক্ষয়ক্ষতি এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
এ নিয়ে টিলা বা পাহাড়কেন্দ্রিক বসবাসকারীদের নানাভাবে বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সাবধানও করা হয়। কিন্তু বসবাসকারীদের অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ হওয়ায় তারা টিলা বা পাহাড়ের পাদদেশের অল্প ভাড়ার ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতেও পারে না।
আবার কখনও প্রভাবশালীরা দখল টিকিয়ে রাখতে অনেককে পাহাড় বা টিলায় নিম্ন আয়ের মানুষকে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের মাইকিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে উচ্ছেদ কিংবা এসব মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতিসহ (বেলা) বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বর্তমানে সিলেট নগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৪০০টি টিলা-পাহাড় রয়েছে। অথচ ১৯৫৬ সালের দিকে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৫। এর মধ্যে গত দেড় দশকে সরকারি হিসাবে ৬১টি টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। বাকি টিলাগুলো দখল করে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি। বর্তমানে জেলায় টিলা-পাহাড়ে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ হাজার।
জানা গেছে, টিলা ও পাহাড় ধসে সিলেট জেলায় গত ১০ বছরে মারা গেছেন অন্তত ২০জন। তার পরও লোকজন সচেতন হয়নি। ধ্বসের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা শহরের পার্শ্ববর্তী জাহাঙ্গীরনগর টিলার (লন্ডনি টিলা) ওপর বসবাসকারী আলী হোসেন, জামাল আহমদসহ একাধিক ব্যক্তি ভোরের আকাশকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে তারা সেখানে বাস করছেন। বৃষ্টি হলে টিলা থেকে নামতে সমস্যা হয়। ধসেরও ভয় তাড়া করে। যেহেতু জায়গা কিনে সেখানে বসবাস করছেন, তাই ঘরবাড়ি ফেলে কোথায় যাবেন!
জাহাঙ্গীরনগর টিলা ছাড়াও নগরী ও এর আশপাশের মজুমদার টিলা, বৃহত্তর বালুচর, নালিয়া, ডলিয়া, খাদিমনগর, শাহপরান উপশহর, বিআইডিসির ভেতরের টিলা, বাহুবল, পীরের বাজার, মেজর টিলা, ইসলামপুর টেক্সটাইল রোড এলাকায় শতাধিক টিলার পাদদেশে কয়েক হাজার পরিবারকে বসবাস করতে দেখা গেছে।
অধিকাংশ টিলার অর্ধেক কিংবা অংশবিশেষ কাটাও হয়েছে। কেউ আবার আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছেন টিলা কেটে। বালুচর, আখালিয়া, ব্রাহ্মণশাসন, করেরপাড়া, খাদিমনগর, দুসকি, বড়গুলসহ বিভিন্ন এলাকায় টিলাকেন্দ্রিক ১০-১২টি হাউজিং প্রকল্প রয়েছে বলে জানা গেছে। মজুমদার টিলা কেটে গড়ে তোলা হয়েছে শান্তিনিকেতন আবাসিক এলাকা।
এ ছাড়া গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাটসহ অন্যান্য উপজেলায় ২ হাজারের মতো পরিবার ঝুঁকি নিয়েই টিলাকেন্দ্রিক বসবাস করছে। এর মধ্যে গোলাপগঞ্জের ধারাবহর, শিলঘাট, নালিউড়ী, খানিশাইল, ফুলশাইন ও চক্রবর্তীপাড়ার টিলাতে প্রায় একশ পরিবার বাস করছে। টিলা বা পাহাড় ইজারা, কাটা ও বিক্রির কোনো বিধান নেই। কিন্তু অভিযোগ আছে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা নানাভাবে টিলা কাটার পাশাপাশি টিলার জায়গাও বিক্রি করে আসছে।
এসব টিলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাসাবাড়ির মধ্যে অধিকাংশই কাঁচা ও খুপড়ি ঘর। মাঝে মধ্যে আধাপাকা বাড়িও রয়েছে। খাদিমপাড়া এলাকার শাহপরান উপশহরের বাসিন্দা রাজনীতিবিদ মুজিবুর রহমান ডালিম জানান, তাঁর এলাকায় অসংখ্য টিলায় শত শত পরিবার বাস করছে। যে কোনো সময় তারা ধসের শিকার হতে পারেন।
বেলার সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আখতার ভোরের আকাশকে বলেন, জেলায় প্রায় ৪০০টি টিলা রয়েছে। অনেক টিলা সম্পূর্ণ, কিছু আংশিকভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। এ কারণে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে হতাহতের ঝুঁকি বাড়ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের বিষয়টি মূলত জেলা ও উপজেলা প্রশাসন দেখে। আমরা টিলা কাটা বন্ধে ব্যবস্থা নিই, নিয়ে থাকি। গত এক বছরে অর্ধশত অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক ভোরের আকাশকে বলেন, বৃষ্টির সময় ধসের ঝুঁকি বেশী থাকে। এ ছাড়াও টিলা কাটার ফলে পাহাড়ে যে কোন সময় ধ্বসের আতঙ্কে থাকতে হয় সর বসবাসকারীদের। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান তিনি।
ভোরের আকাশ/নি