মো. কামরুজ্জামান, বাগেরহাট: বাগেরহাটের শরণখোলায় এ বছর আলু চাষে ব্যাপক ধস নেমেছে। মৌসুমের শুরুর দিকে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির আঘাত, এর পর থেকে একের পর এক দুর্যোগ এবং বীজের দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধিই আলু চাষের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এবার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার শঙ্কায় পড়েছে কৃষি বিভাগ।
পাশাপাশি সার, কীটনাশক, শ্রমিকের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে চাষের খরচ। যে কারণে আলু চাষে আগ্রহও কম চাষিদের। তা ছাড়া ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বীজ রোপণের উত্তম সময়। সেই সময়ও প্রায় শেষের পথে। এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তিনের একাংশ জমিও চাষ হয়নি।
সময়মতো চাষাবাদ না হওয়ায় শত শত মণ বীজ আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন আড়তদাররাও। বীজ আলু এখন খাবার আলু হিসেবে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। মূলত মৌসুমের শুরুতেই ঘূর্ণিঝড় মিধিলির বৃষ্টি পেছনে ফেলেছে আলুচাষিদের। সব মিলিয়ে এ বছর চরম বিপর্যয় দেখা দিতে পারে আলু চাষে। এমন পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষি-আড়তদার উভয়েই।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, শরণখোলায় গত বছর প্রায় সাড়ে ৭০০ বিঘা (১০০ হেক্টর) জমিতে আলু চাষ হয়েছিল। তাতে উৎপাদন হয় ২২ হাজার মণ আলু। এখানকার উৎপাদিত আলু ঢাকা, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা এসে ট্রাক ভরে নিয়ে যান। এতে উপকূলীয় এই অঞ্চলের চাষিরা ব্যাপক লাভবান হন।
এ বছর চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ৯০০ বিঘা। প্রতিবছর ১৫ নভেম্বর থেক শুরু হয় আলুর চাষাবাদ। এ বছর নানামুখী সংকটের কারণে এখন পর্যন্ত জমিই প্রস্তুত করতে পারেননি অনেক চাষি। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের রাজৈর গ্রামের আলুচাষি মো. দুলু তালুকদার জানান, প্রতিবছর এমন সময় আলুর বীজ রোপণ শুরু হয়। এবার জমিতে পানি এবং মাটি ভেজা থাকায় চাষ করা যাচ্ছে না। আমন ধান ওঠার পর তাদের গ্রামে আলু চাষের অধিকাংশ জমি ফাঁকা পড়ে আছে। এবার অসময়ে ঝড়-বৃষ্টি এবং বীজের দাম অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে হতাশায় পড়েছেন তারা।
এই চাষি জানান, গত বছর ১০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। বিঘাপ্রতি চাষাবাদে খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা। আলু পেয়েছিলেন ২ হাজার মণ। সব খরচ বাদে তার লাভ হয়েছিল প্রায় ৩ লাখ টাকা। গত বছর ৫০ কেজির এক বস্তা বীজ আলু কেনা হয়েছিল ১ হাজার টাকায়। চাষি হতাশা প্রকাশ করে জানান, বীজ, সার, কীটনাশক ও চাষের খরচ যেভাবে বেড়েছে, তাতে এবার অনেকেই আলু চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না চাষিরা। ফলে গতবারের তুলনায় এবার অনেক কম জমিতে আলু চাষ হবে।
উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারের আলু ব্যবসায়ী মেসার্স আল-মদিনা ভাণ্ডারের মালিক মো. নাসির উদ্দিন মোল্লা জানান, প্রতিবছর মৌসুমে তার আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার মণ বীজ আলু বিক্রি হয়। সেখানে এ বছর মাত্র এক হাজার মণ বীজ বিক্রি হয়েছে। চাষিরা না নেয়ায় বীজ আলু এখন খাবার আলু হিসেবে বিক্রি করতে হচ্ছে।
আড়তদার নাসির মোল্লা আরও জানান, মুন্সীগঞ্জ মোকাম থেকে ডায়মন্ড জাতের বীজ আলু কেনেন। গত বছর ৫০ কেজির এক বস্তা আলু পাইকারি কেনা ছিল সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। এবার সেই বীজ মোকামেই কিনতে হচ্ছে ২ হাজার টাকায়। প্রকারভেদে সেই বীজ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায়। সব ব্যবসায়ীই এ বছর বীজ আলু নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
রায়েন্দা বাজারের কীটনাশক ব্যবসায়ী মেসার্স আয়শা এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. এনামুল কবির জমাদ্দার জানান, আলু চাষের জন্য জিপসাম পাউডার, ম্যাগনেশিয়াম, দস্তা সার এবং প্রাইমেট কীটনাশক বেশি ব্যবহার হয়। আলু চাষকে লক্ষ্য করে কয়েক লাখ টাকার সার ও কীটনাশক মজুদ করেছেন। প্রতিবছর এই সময় প্রচুর পরিমাণে সার-কীটনাশক বিক্রি হয়। কিন্তু এ বছর বিক্রি হতাশাজনক। তা ছাড়া সার-কীটনাশকের দামও কিছুটা বেড়েছে এবার।
শরণখোলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার বলেন, বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি আলুচাষিদের অনেক পেছনে ফেলেছে। সেই থেকে কয়েক দফা এবং বর্তমানেও চলমান দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষিরা। মৌসুমও শেষের পথে। মাটি নরম থাকায় বহু জমি এখনো চাষযোগ্য হয়নি। তা ছাড়া বীজের দাম বেড়ে দ্বিগুণসহ অন্যান্য খচরও বেড়েছে। এতে হতাশায় পড়েছেন চাষিরা।
কৃষি কর্মকর্তা আরো বলেন, আমাদের উপজেলার মাটি আলু চাষে খুবই উপযোগী। কৃষি বিভাগের পরামর্শে চাষির সংখ্যাও বাড়ছে। গত বছর ১০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছিল। তাতে হেক্টরপ্রতি প্রায় ৬০০ মণ আলু উৎপাদন হয়েছে। এ বছর ১২০ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে চাষিদের উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু নানা কারণে এবার আলু চাষে অনেকটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। সময়মতো চাষাবাদ করতে পারলে এ বছরও ব্যাপক ফলন পাওয়া যেত।
ভোরের আকাশ/ সু