logo
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১৫:২৮
বাঁওড় ইজারা
মাছ ধরা বন্ধ, সংসার চলছে না জেলেদের
কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি

মাছ ধরা বন্ধ, সংসার চলছে না জেলেদের

জয়দিয়া বাঁওড়পাড়ের জেলেদের চোখেমুখে বিষণ্নতার ছাপ

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঝিনাইদহ ও যশোর অঞ্চলের ছয়টি বাঁওড়পাড়ের জেলে সম্প্রদায়। কারণ বছরের পর বছর তারা ওই ছয়টি বাঁওড়ে মাছ ধরে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। বাঁওড়ই ছিল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক সিদ্ধান্তে সেগুলো ইজারা দেয়ায় তারা কর্ম হারিয়ে পথে বসতে চলেছে। প্রায় ২৫-৩০ হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ইজারাদাররা এসব বাঁওড়ে মাছ চাষ করায় জীববৈচিত্র্য ও দেশীয় প্রজাতির মাছ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বলুহর ও জয়দিয়া, মহেশপুরের কাঠগড়া ও ফতেপুর, কালীগঞ্জের মর্জাদ এবং যশোরের চৌগাছা উপজেলার বেড়গোবিন্দপুর এ ছয়টি বাঁওড়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরের চুক্তির মাধ্যমে ১৯৭৯ সাল থেকে বিল বাঁওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে মাছ চাষ শুরু হয়। এখানে সুবিধাভোগীরা ছিল বাঁওড় পাড়ের জেলেরা। ১৯৮৬ সাল থেকে বাঁওড়টি রাজস্ব খাতে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে আরও কয়েক দফা চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে ভূমি মন্ত্রণালয়। এখানে উৎপাদিত মাছের ৩৫ শতাংশ পেত মৎস্য অধিদপ্তর। ভূমি মন্ত্রণালয় পেত ২৫ শতাংশ ও জেলে সম্প্রদায় পেত ৪০ শতাংশ। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত রানী মাছের শতভাগই পেত জেলেরা। সর্বশেষ ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের চুক্তির মেয়াদ ছিল চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত।

 


পরে আর ভূমি মন্ত্রণালয় চুক্তি বৃদ্ধি করেনি। বরং চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ভূমি মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই ছয়টি বাঁওড় ইজারা প্রক্রিয়া শুরু করে। এ বছরের এপ্রিলে ইজারাদারদের বাঁওড় বুঝিয়ে দেয়া হয়। জলমহাল ইজারার বিজ্ঞপ্তিতে নিবন্ধনকৃত ও প্রকৃত মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির আবেদনের কথা বলা হলেও এখানে একাধিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নিয়ে মৎস্যজীবী নন এমন ব্যক্তিদের ইজারা পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ করেছে বাঁওড় পাড়ের প্রকৃত জেলেরা। ফলে তাদের জীবন ও জীবিকায় দেখা দিয়েছে সংকট।

 


জয়দিয়া বাঁওড় ও মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শীতল কুমার হালদার ভোরের আকাশকে বলেন, ‘সংসার চালাতে পারছি না। বাঁওড়ে মাছ ধরা বন্ধ, আমরা পথে বসে গেছি। আমার বাবা ৪০ বছরের অধিক সময় এই বাঁওড় থেকে মাছ ধরে সংসার চালিয়েছেন। আমরাও বাঁওড়ের মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আসছিলাম। এখন মাছ ধরা তো দূরের কথা, ইজারাদাররা আমাদের বাঁওড়েও নামতে দেয় না। কী করব ঝুঝে উঠতে পারছি না।’

 


বলুহর বাঁওড় ও মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি গোপাল হালদার বলেন, ‘বাঁওড় পাড়ের মৎস্যজীবীরা বেকার হয়ে গেছি। বাপ-দাদারা এ বাঁওড় থেকে মাছ ধরেই সংসার চালাতেন। আমরাও একই পেশায় ছিলাম। ছয়টি বাঁওড় পাড়ের জেলে সম্প্রদায়ের এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে।’

 


বলুহর বাঁওড় ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমান বলেন ‘মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির মাছের আকার ও সংখ্যা বিবেচনা করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাঁওড়ে মাছের চাষ করা হতো। মাছ ধরার সময়ও নির্ধারণ করা থাকত, ছোট মাছ ধরা হতো না। একই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য তথা বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য অভয়াশ্রম করা হতো।’ তার অভিযোগ, বর্তমান ইজারাদাররা এ বিষয়ে যত্নশীল না হয়ে অধিক মুনাফার জন্য কৃত্রিম উপায়ে মাছ চাষ করছে। যখন-তখন মাছ ছাড়ছে এবং ধরছে। যে কারণে দেশীয় মাছ ও জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে।

 


জয়দিয়া বাঁওড় এলাকার বাসিন্দা নিত্য হালদার বলেন, ‘বাঁওড় পূর্বের ন্যায় ফিরে পেতে মৎস্যজীবীদের পক্ষ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি হাইকোর্টে চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আছে। তারপরও ইজারাদাররা বাঁওড় পাড়ের জেলেদের মারধর করে জোরপূর্বক মাছ ধরছে।’

 


যশোর বিল বাঁওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. আলফাজ উদ্দীন শেখ ভোরের আকাশকে বলেন, এ বাঁওড়গুলো গত ৪২ বছর আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সে সময় বাঁওড় পাড়ের জেলেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করেছি। পাশাপাশি পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঁওড়ের বড় মাছের চাষ ও দেশীয় ছোট মাছের প্রজনন ঘটিয়ে নানা প্রজাতির মাছের চাহিদা মেটানো হয়েছে। এখন জেলেরা তো বেকার হয়েছে, পাশাপাশি বাঁওড় সংশ্লিষ্ট ১৩০-১৪০ জন দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মীও বেকার হয়ে গেছে।’

 


এ ছাড়া বলুহর বাঁওড় সংলগ্ন সরকারি মৎস্য হ্যাচারি কমপ্লেক্সসহ অন্যান্য বাঁওড়ের আশপাশে কৃষিজমির পানি শ্যালো পাম্পের মাধ্যমে বাঁওড় থেকে নেওয়া হতো। অভিযোগ রয়েছে ইজারাদাররা বাঁওড় থেকে পানি নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এতে যেমন শত শত একর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হবে, তেমনি সরকারি মৎস্য হ্যাচারি কমপ্লেক্সও পানি সংকটে পড়বে।

 


বলুহর বাঁওড় পাড়ের কৃষক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘বাঁওড়ের কাছেই আমার সাড়ে চার বিঘা জমি। শুকনো মৌসুমে শ্যালো মেশিনে বাঁওড়ের পানি দিয়ে চাষাবাদ করে আসছি। কিন্তু বর্তমানে ইজারাদাররা পানি নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

 

বাঁওড় পাড়ের আরেক কৃষক ফারুক হোসেন বলেন, ‘বাপ-দাদার সময় থেকেই বাঁওড়ের পানি দিয়ে চাষাবাদ করে আসছি। কিন্তু ইজারাদারের লোকজন বাঁওড় থেকে পানি নিতে দিচ্ছে না। এখন কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।’

 


অবশ্য পানি বন্ধ করে দেয়ার সত্যতা পাওয়া গেল বলুহর বাঁওড় ইজারা পাওয়া কোটচাঁদপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শীতল হালদারের কথায়ও। তিনি বলেন, ‘বাঁওড় থেকে পানি উত্তোলন না করতে এরইমধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছি।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে আমরা কাউকে ইজারা পাইয়ে দিইনি। এমনকি বাঁওড় কাউকে সাব-লিজও দেয়া হয়নি।’

 


জানতে চাইলে ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভূমি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর বাড়ানো হয়নি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রক্রিয়া শেষে এসব বাঁওড় ইজারা দেয়া হয়েছে। এতে বাঁওড়ের পূর্বের সুবিধাভোগীরা বঞ্চিত হয়েছে বলে দাবি করেছে। তারা স্মারকলিপি দিয়ে হতাশা ও কষ্টের কথা জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে স্মারকলিপি পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

 

ভোরের আকাশ/ সু