শরীয়তপুরে কৃষিজমিতে মাছের খামার তৈরির হিড়িক পড়েছে। কৃষকদের বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে খামারের মালিকরা সহজেই কৃষিজমিতে জলাশয় বানিয়ে মাছ চাষ করছেন। ফলে দিন দিন কমে যাচ্ছে ফসলি জমি।
জানা যায়, একদিকে অনাবৃষ্টি, পানি সংকট, অন্যদিকে বর্ষার পর জলাবদ্ধতার কারণে শরীয়তপুরে কাক্সিক্ষত ফসল উৎপাদন হচ্ছে না। মাছের খামারের জন্য জমি ভাড়া দেয়া বেশি লাভজনক হওয়ায় জমির মালিকরা ভাড়া দিচ্ছেন। এভাবে ফসলি জমি কমতে থাকলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ।
সম্প্রতি শরীয়তপুরের কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। সদর উপজেলার সোনামুখী স্লুইসগেটের পশ্চিম পাশে ওলিউল্লা তফাদারের বাড়ির পাশে প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষিজমিতে গেদা গাজী, গনি ঘরামি ও রব মাল পুকুর খনন করছেন।
নড়িয়া উপজেলার ভোজেস্বর ইউনিয়নের আচুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ৪০ শতাংশ জমির ওপরে মো. মিজান মাছের খামার করছেন।
গোসাইরহাট উপজেলার কুচাইপট্টি ইউনিয়নে সাইক্কা ব্রিজের পাশে ২৫ শতাংশ জমির ওপর মনির হোসেন মাছের খামার করার জন্য ভেকু দিয়ে ফসলি জমি কাটছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে ৮৪ হাজার ৮১৪ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। ২০১৩ সালে ছিল ৮৬ হাজার ১৯০ হেক্টর। অর্থাৎ ১০ বছরে আবাদি জমি কমেছে ১ হাজার ৩৭৬ হেক্টর। আবাদি জমির মধ্যে এক ফসল উৎপাদন হয় ১৩ হাজার ৫৯৯ হেক্টরে, দুই ফসল উৎপাদন হয় ৫৬ হাজার ২৩৪ হেক্টরে, তিন ফসল উৎপাদন হয় ১০ হাজার ৮৬১ হেক্টরে এবং চার ফসল উৎপাদন হয় ২২০ হেক্টরে। জেলায় খাদ্যশস্যের চাহিদা ১ লাখ ৬৬ হাজার ২৮২ টন। উৎপাদন হয় ২ লাখ ২২ হাজার ২২৪ টন।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ২ হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে মোট ১৫ হাজার ১৮২টি পুকুর ও মাছের খামার রয়েছে। এর মধ্যে ২২৩টি বড় খামার রয়েছে। মাছ চাষি আছেন ১৪ হাজার ৩৭৮ জন।
কৃষক ও খামারিরা জানান, কৃষকের কাছ থেকে একরপ্রতি জমি বছরে ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। এসব জমির ভাড়ার মেয়াদ আট থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। এসব নিচু জমিতে বছরে এক ফসল আবাদ করা যেত। ধান ছাড়া এই জমিতে অন্য কোনো ফসল আবাদ করা সম্ভব নয়। এখন ধান আবাদে অনেক খরচ পড়ে যায়। তাই ধান আবাদ করলেই প্রতি বছর লোকসানের পাল্লা ভারি হতে থাকে। এ জন্য কৃষক বাধ্য হয়ে তাদের ফসলি জমি মাছের খামার করতে দিয়ে দিচ্ছেন।
গোসাইরহাটের কুচাইপট্টি ইউনিয়নের কুচাইপট্টি গ্রামের কৃষক মিনু মাঝি বলেন, ধান উৎপাদনে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয় সে পরিমাণ লাভ হয় না। কিন্তু মাছ চাষে বেশি লাভ হওয়ার কারণে অনেক কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে এখন মাছ চাষ করছেন।
নড়িয়ার মুক্তারের চর ইউনিয়নের নয়ন মাদবরকান্দি গ্রামের কৃষক দিন ইসলাম, ছমেদ খান ও রুবেল জানান, তারা বংশপরম্পরায় জমিতে ধান, পাট, গম, পেঁয়াজ, রসুন, জিরা, ধনিয়া, সরিষাসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফসল আবাদ করতেন। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফসল উৎপাদনে খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু ফসল উঠিয়ে বাজারে নিয়ে গেলে যে দাম পান তাতে লাভ তো দূরের কথা, ফসল উৎপাদন খরচও ওঠে না। প্রতি বছর এমন লোকসানের কারণেই মাছ চাষিদের কাছে জমি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছেন। এতে তারা লাভবান হচ্ছেন।
ডামুড্যার কনেশ্বর ইউনিয়নের ছাতিয়ানি গ্রামের মাছ চাষি সবুজ মির বলেন, জেলায় মাছ চাষিদের সংখ্যা এখন দিন দিন বাড়ছে। এই জেলায় অনেক প্রবাসী রয়েছেন। তারা বিদেশ থেকে এসে ভালো কোনো ব্যবসা না পেয়ে জমি কিনে আবার কেউ জমি ভাড়া নিয়ে তা কেটে মাছের খামার করছেন। বছরে কোনো জমি শতাংশপ্রতি ৫০০, কোনো জমি ১ হাজার টাকায় ভাড়া নিতে হয়। এতে কৃষকরা আগের চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন।
শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. রবিআহ নূর আহমেদ বলেন, তারা বিভিন্ন উপজেলায় ইউএনওদের নিয়ে কিছু আবাদি জমি অবমুক্ত করেছেন; আরও কিছু প্রক্রিয়াধীন। আবার কিছু জায়গায় হাত দেওয়া যাচ্ছে না। নগরায়ণে গেলে কিছু জমি নষ্ট হবেই এটা সারা পৃথিবীর নিয়ম। এর পরও শরীয়তপুরে মাছের খামার করার প্রবণতা বেড়েছে। তাই ফসলি জমিও কমে যাচ্ছে।
ভোরের আকাশ/ সু