logo
আপডেট : ৩ জানুয়ারি, ২০২৪ ১৫:৪৬
মৎস্য উৎপাদনের আঁতুড়ঘর ধ্বংসের মুখে
দূষণের কারণে মিলছে না মাছ
রামু (কক্সবাজার) প্রতিনিধি

মৎস্য উৎপাদনের আঁতুড়ঘর ধ্বংসের মুখে

বাঁকখালী নদীতে জাল ফেলেও মিলছে না মাছ

আকাবাঁকা হয়ে রামুর ৭ ইউনিয়নের বুক চিরে বয়ে গেছে বাঁকখালী নদী। একসময় এই উপজেলার নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা গড়ে উঠেছিল এই বাঁকখালীকে কেন্দ্র করে।

 


নদীর দু’পাড়ের বাসিন্দারা চাষাবাদের পাশাপাশি নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। অর্থাভাবে অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তই সাগরের মাছ কিনতে পারত না। মাছের চাহিদা মেটাতে স্থানীয়রা কৃষিকাজ শেষে জাল, পলো (টিনের তৈরি গোল করে মোড়ানো), বড়শি নিয়ে মাছ শিকারে নেমে পড়তেন। তখন দেশীয় প্রজাতির অনেক মাছে পূর্ণ থাকত এই নদী।

 


বাঁকখালী নদীর মাছ সুস্বাদু হওয়ায় হাট-বাজারে এর কদর ছিল। জেলেরাও প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে মাছ শিকার করে সেসব বাজারে বিক্রি করতেন। সেই সোনালি দিন এখন অতীত। এখন আর আগের মতো বাঁকখালী নদীতে মাছ পাওয়া যায় না।

 


আগের মতো রামুর কোনো হাটবাজারে বাঁকখালীর মাছ পাওয়া যায় না। সেই সঙ্গে স্থানীয় ও জেলেদের জীবিকায়ও ভাটা পড়েছে। আজকাল তাদেরকে নদীতে মাছ শিকারেও দেখা যায় না। মাছ না পাওয়ায় পেশাদার জেলেরা এখন অন্যান্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।

 


এদিকে পরিবেশবিদরা বলছেন নদীতে ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থ, আবর্জনা ও বিষ প্রয়োগের কারণে দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে নদীর দেশীয় মাছ।

 


সরেজমিনে রামুর কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে এই প্রতিনিধি বাঁকখালী নদীর পাড়ে আবর্জনার ছোট-বড় অনেক স্তূপ দেখতে পেয়েছেন। অনেকে আবার নদীতে মুরগির খামারের উচ্ছিষ্টাংশ ফেলছেন। বিভিন্ন অংশে শৌচাগারের মলমূত্র নদীর পানিতে মিশেছে। এছাড়া পোল্ট্রি খামারের মৃত মুরগি এবং গরু, কুকুর পানিতে পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। যা নদীর পানি ও পরিবেশ দূষণের অন্যতম।

 


নদীতে মাছ শিকারে আসা অফিসের চর এলাকার এক যুবক মো. ফারুক বলেন, ‘আগে নদীতে জাল ফেললে অনেক মাছ পাওয়া যেত। এখন সারাদিনে আধা কেজি মাছও পাওয়া কষ্টকর।’

 


নদী খননের তাগাদা দিয়ে একজন স্থানীয় বাসিন্দা মো. কাইয়ুম উদ্দিন বলেন, ‘নদীর নাব্যতা সংকট হলো প্রধান কারণ। এ জন্য নদী খনন করা জরুরি। এছাড়া হাটবাজার, স্টেশন, দোকানের আবর্জনা যত্রতত্র ফেলায় নদী দূষিত হচ্ছে।’

 


তিনি আরও বলেন, ‘জনশ্রুত হয়েছি, মাছকে অচেতন করতে কিছু অসাধু ব্যক্তি প্রতিনিয়ত নদীর পানিতে বিষাক্ত কীটনাশক ও মেল (এক ধরনের উদ্ভিদের রস) ব্যবহার করে। এসব পানিতে মেশালে মাছ প্রায় অর্ধমৃত হয়ে পানিতে ভেসে থাকে। জানাজানি হলে স্থানীয় মানুষ সেসব মাছ ধরেন। তখন প্রতি মাসে নদীর দু’পাড়ে মানুষের ভিড় দেখা যায়। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে হবে। এসব কারণে নদী থেকে রেণু ও পোনা মাছের বংশ বিলোপ সাধন হয়ে যাচ্ছে।’

 


রামু উপজেলা মৎস্য অফিসের মেরিন ফিশারিজ কর্মকর্তা মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘বাঁকখালী নদী মাছের প্রাকৃতিক একটি আবাসস্থল। বলতে গেলে মাছের আঁতুড়ঘর বলা যায়। দিন দিন এই নদীতে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কয়েক বছর বাঁকখালীতে বিভিন্ন মাছের পোনাও অবমুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট এই অসেচতনায় নদীর পানি দূষিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে মাছ পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাচ্ছে না।’

 


তিনি আরও বলেন, ‘নদী সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি, কৃষি জমিতে কীটনাশকের পরিমিত ব্যবহার, আবর্জনা,পলিথিন, প্ল্যাস্টিক ক্ষতিকর দ্রব্য পানিতে মেশানো বন্ধ করতে হবে।’

 


রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) আফসানা জেসমিন পপি বলেন, ‘বাঁকখালীর পানি দূষণের ফলে এই নদীর সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য হারাচ্ছে। সবার সচেতনতা জরুরি। আর নদীতে ক্ষতিকর কীটনাশক ও মেল ব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে পারলে উপজেলা প্রশাসন আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।’ বিভিন্ন কারণে দেশীয় অর্ধশত প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। এখন আর পুকুর ভরা মাছ নেই। “মাছে ভাতে বাঙালি”প্রবাদটিও এখন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। বিকল্প হিসেবে এসেছে শুটকি ও সামুদ্রিক মাছের আমদানি।

 


জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসচেতনতা, অবাধে লবণ পানি তুলে বাগদা চিংড়ি চাষ, ফসলের ক্ষেতে দেশীয় অর্ধশত প্রজাতির ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের যথেচ্ছা ব্যবহার এবং মিঠাপানির অভাবে মৎসখনি খ্যাত অর্ধশত প্রজাতির মিঠাপানির দেশীয় মাছের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। সুস্বাদু দেশীয় মাছ এখন আর তেমন মিলছে না।

 


বাজারে যদি বিদেশি ক্রস ও কার্প জাতীয় মাছ না থাকতো তাহলে আমিষের চাহিদা মিটানো সম্ভবপর ছিলো না। গ্রামেগঞ্জে সর্বত্রই দেশীয় মাছের চরম সংকট। যা পাওয়া যায় তারও অগ্নিমূল্য। বিগত দিনে সরকারের উদাসীনতা, মৎস্য অধিদফতরের বাস্তবসম্মত সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের অভাব এবং যে সকল প্রকল্প ও কর্মকাণ্ড হাতে নেয়া হয়েছিল তার যথাযত বাস্তবায়ন না করায় এ সেক্টরটি “শিকেয়” উঠেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

 

ভোরের আকাশ/ সু