logo
আপডেট : ৭ জানুয়ারি, ২০২৪ ১০:১৭
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন
সোয়া দুই হাজার কোটি টাকার ভোটের আয়োজন
নিজস্ব প্রতিবেদক

সোয়া দুই হাজার কোটি টাকার ভোটের আয়োজন

আগামী পাঁচ বছর জাতীয় সংসদে দেশের সংসদীয় আসনগুলোর প্রতিনিধিত্ব যারা করবেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যালট পেপারে সিল মেরে সেই রায় জানাবে দেশের প্রায় ১২ কোটি ভোটার। প্রায় দুই হাজার প্রার্থীর মধ্যে থেকে ২৯৯ জনকে বেছে নেবেন ভোটাররা।

 


বিএনপিসহ ১৬টি দল বর্জনের মধ্যে আজ রোববার এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত ২৮ দলের দেড় সহস্রাধিক এবং প্রায় সাড়ে চারশ’ স্বতন্ত্র প্রার্থী।

 


ইতোমধ্যে ভোটকে ঘিরে অবরোধ, হরতালের কর্মসূচির মধ্যে বেশ কিছু গোলযোগ, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, হয়েছে প্রাণহানি। আবার ভোটারদের কেন্দ্রে টানতে নানা উদ্যোগও রয়েছে এবার। কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।

 


শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতায় সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূরে ঠেলে উৎসবমুখর ভোটের প্রত্যাশা করছে ইসি। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, নির্বাচনের এ যাত্রা ‘কুসুমাস্তীর্ণ নয়’। তারপরও সবার মিলিত প্রচেষ্টা ও দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জনগণ ও বহির্বিশ্বের কাছে নির্বাচনকে ‘গ্রহণযোগ্য’ করার বিষয়ে মনোযোগ রয়েছে।

 


বিএনপিবিহীন এ নির্বাচনে সমাঝোতা আর জোটের হিসাব-নিকাশের মধ্যে অন্তত শতাধিক আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, ভোটের লড়াইয়ে থাকা শ’খানেক স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, যারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের পদধারী।

 


নিজেদের শক্তি আর জনপ্রিয়তা দেখাতে গিয়ে এরই মধ্যে গোটা ২৫ আসনে প্রতিপক্ষের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, প্রচারে বাধা দেওয়া, মারধর, হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতার তথ্য এসেছে সংবাদমাধ্যমে, অন্তত তিনজনের মৃত্যুও হয়েছে।

 


ভোটের মাঝপথে নওগাঁ-২ আসনের একজন প্রতিদ্বন্দ্বির মৃত্যু হওয়ায় এখানে পরে ভোট হবে। এ আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দুইজন প্রার্থী রয়েছেন, নতুন তফসিলে নতুন প্রার্থীও যোগ হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

 


আজ যে ২৯৯ আসনে ভোট চলছে, সেখানে প্রার্থী রয়েছেন ১৯৬৯ জন। এরমধ্যে স্বতন্ত্র ৪৩৭ জন এবং বাকি ১৫৩২ জন দলীয় প্রার্থী। এবার রেকর্ড ৯৭ জন নারী প্রার্থী ভোটের লড়াইয়ে আছেন।

 


৪২ হাজারেরও বেশি ভোটকেন্দ্রের ২ লাখ ৬০ হাজার ভোটকক্ষে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন ভোটাররা। ঢাকার সূত্রাপুর এলাকায় বৃহস্পতিবার নৌকার প্রার্থী সাঈদ খোকনের ভোটের প্রচারণা উৎসবে রূপ নেয়।


এ নির্বাচনে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা পুরো দেশ। আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সাড়ে সাত লাখের মত সদস্য, ৯ লাখের মত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা এবং রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, নির্বাহী হাকিম, বিচারিক হাকিমসহ আরো অনেক লোক নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন।
এছাড়া দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, স্থানীয় ও বিদেশি-পর্যবেক্ষক রয়েছেন ২৫-৩০ হাজারের মত।

 


তফসিল:প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। বর্তমান কমিশনের চার সদস্য নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল তফসিল ঘোষণা করেন ১৫ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র জমার শেষ সময় ছিল ৩০ নভেম্বর।

 


বাছাই ১-৪ ডিসেম্বর
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ছিল ১৭ ডিসেম্বর। ভোট আজ ৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর প্রার্থীরা প্রচার শুরু করেন, সেই সুযোগ শেষ হয় ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টায়।

 


২৯৯ আসনের ভোট তথ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী
ভোটার ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৪ জন। পুরুষ ভোটার ৬,০৫,৯২,১৯৭; নারী ৫,৮৭,৩৯,৮৮৯ ও হিজড়া ৮৪৮। ভোটকেন্দ্র- ৪২,০২৪টি। ভোটকক্ষ ২,৬০,৮৫৬টি। ২৯৯ আসনে ১৯৬৯ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে ১৫৩২ জন ২৮টি রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী; বাকি ৪৩৭ জন স্বতন্ত্র।

 


কোন দলের কত প্রার্থী
আওয়ামী লীগ (নৌকা) ২৬৫ জন, এর বাইরে নওগাঁ-২ আসনে একজন রয়েছেন। জাতীয় পার্টি (লাঙ্গল) ২৬৪ জন, এর বাইরে নওগাঁ-২ আসনে একজন রয়েছেন।

 


এছাড়া জাকের পার্টি (গোলাপ ফুল) ২১ জন, তৃণমূল বিএনপি (সোনালী আঁশ) ১৩৫ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (আম) ১২২ জন, বাংলাদেশ কংগ্রেস (ডাব) ৯৬জন, জাসদ (মশাল) ৬৬ জন, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (একতারা) ৭৯ জন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (ছড়ি) ৬৩ জন, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ (টেলিভিশন) ৪৫ জন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম (নোঙ্গর) ৫৬জন, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন (ফুলের মালা) ৩৮ জন, ইসলামী ঐক্যজোট (মিনার) ৪২ জন; ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (চেয়ার) ৩৯ জন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মোমবাতি) ৩৭ জন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ (গামছা) ৩০ জন, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি (হাতুড়ি) ২৬ জন, গণফ্রন্ট (মাছ) ২১ জন, জাতীয় পার্টি-জেপি (বাই সাইকেল) ১৩ জন, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি (হাতঘড়ি) ১৬ জন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (বটগাছ) ১১ জন, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ (কুলা) ১০ জন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল) ৫ জন, গণতন্ত্রী পার্টি (কবুতর) ১০ জন, গণফোরাম (উদীয়মান সূর্য) ৯ জন, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল (চাকা) ৪ জন, বাংলাদেশ ন্যশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (কুঁড়েঘর) ৫ জন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল (হাত পাঞ্জা) ৪ জন ও স্বতন্ত্র ৪৩৭ জন।

 


ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পাশাপাশি তাদের শরিক ওয়র্কার্স পার্টি, জাসদ, জেপির ছয় জন নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।

 


ভোটের খরচ
নির্বাচন পরিচালনা ও আইন শৃঙ্খলা খাত মিলিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রায় সোয়া দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা খাতে এক তৃতীয়াংশ খরচ হবে, বাকি দুই তৃতীয়াংশই যাবে নিরাপত্তা খাতে।

 


বিধিনিষেধ
ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকে ভোটের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা অর্থাৎ শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে ৯ জানুয়ারি বিকাল ৪টা পর্যন্ত সভা, সমাবেশ, মিছিল ও শোভাযাত্রা করা যাবে না। নির্বাচনের আগে ও পরে মিলিয়ে ৭২ ঘণ্টা দেশজুড়ে মোটর সাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ, যা শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুরু হয়। তবে সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক বা জরুরি কাজে ব্যবহৃত মোটর সাইকেল চলতে পারবে-এজন্য রিটার্নিং অফিসারের অনুমোদন নিতে হবে এবং স্টিকার প্রদর্শন করতে হবে।

 


একই সঙ্গে ট্যাক্সি ক্যাব, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক চলাচলও বন্ধ থাকবে শনিবার মধ্যরাত থেকে ভোটের দিন রোববার মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও অনুমতিপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষকদের বহনকারী যানবাহনের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না। জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহন, ওষুধ, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ও এ ধরনের কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি ও সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন চলাচলে কোনো বাধা নেই।

 


এছাড়া বিদেশ থেকে দেশে আসা এবং বিদেশে যাওয়া ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনকে বহনকারী যানবাহন চলাচলে বাধা থাকবে না। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উড়োজাহাজের টিকেট দেখাতে হবে। দূরপাল্লার যাত্রী বহনকারী এবং দূরপাল্লার যাত্রী হিসেবে স্থানীয় পর্যায়ে যাতায়াতের জন্য যেকোনো ধরনের যানবাহন চলাচলেও কোনো বাধা থাকছে না।

 


অপরদিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জন্য একটি এবং প্রার্থীর এজেন্টদের জন্য একটি গাড়ি রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে স্টিকার দেখিয়ে চলাচল করতে পারবে।

 


অ্যাপে ভোটের তথ্য
‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি অ্যাপে’ এর হোম পেইজে ‘নির্বাচনের তথ্য’ ও ‘নির্বাচনি ফলাফল’ বাটন রয়েছে। এ পেইজে আসনগুলোর তথ্য, এক নজরে, আইনবিধি, নিবন্ধিত দল ও নোটিস বোর্ড বাটন রয়েছে। আসনগুলোর তথ্যে বিভাগভিত্তিক আসন, সেই আসনের প্রার্থী পরিচিতি ও ভোটকেন্দ্রের তথ্য রয়েছে।

 


কেন্দ্রের তথ্য জানার পাশাপাশি একনজরে বাটনে মোট ভোটার, নারী-পুরুষ, দল, প্রার্থী সংখ্যার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি ২ ঘণ্টা অন্তর চলমান ভোটিং কার্যক্রমের তথ্য ও কত ভোট পড়ল, সেই তথ্যও জানা যাবে অ্যাপে।

 


আরও যেসব নির্দেশনা
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, কেন্দ্রের ভেতরে কেবল প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এবং কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের ইনচার্জ মোবাইল ব্যবহার করতে পারবেন। ভোটাররা কোনোভাবেই বুথ বা কেন্দ্রের ভেতরে ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। ভোটাররা কেউ মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রে গেলেও তা বন্ধ রেখে যেতে হবে। ভোট দিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন পড়বে না। তবে ভোটারের এনআইডি নম্বর, ভোটার নম্বর বা স্মার্ট কার্ড সঙ্গে থাকলে ভোটার তালিকা থেকে নাম বের করতে সুবিধা হবে।

 


ভোটের কর্মী বাহিনী
৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার জেলা এবং ৫৯০ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার উপজেলা পর্যায়ে সার্বিক তত্ত্বাবাধনে দায়িত্ব পালন করছেন।
৪২ হাজার ২৪ জন প্রিজাইডিং অফিসার থাকবেন কেন্দ্রের দায়িত্বে। তাদের অধীনে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৫৬ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং ৫ লাখ ৪২ হাজার ২৫৬ জন পোলিং অফিসার ভোটগ্রহণের মূল কাজটি করছেন।

 


নিরাপত্তা
ভোটের মাঠের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ৮ লাখ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। সশস্ত্রবাহিনী প্রায় ৩৮ হাজার দেড়শ জন এবং নৌবাহিনী প্রায় দুই হাজার আটশ’ জন। প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার পুলিশ; প্রায় ৫ লাখ ১৪ হাজার আনসার। বিজিবি ১১৫১ প্লাটুন (৪৪ হাজার ৯০০ জন প্রায়) ৬০০ টিম র‌্যাবের, রিজার্ভ ৯৫ টিম। কোস্ট গার্ড ৭০ প্লাটুন (প্রায় ২৩০০ জন)। ভোটকেন্দ্রে ১৫-১৭ জন নিরাপত্তা সদস্য রয়েছেন। সারা দেশে প্রায় তিন সহস্র নির্বাহী হাকিম এবং সহস্রাধিক বিচারিক হাকিম রয়েছেন।

 

ভোরের আকাশ/ সু