logo
আপডেট : ২০ জানুয়ারি, ২০২৪ ১৬:৫২
ময়মনসিংহে লক্কড়ঝক্কড় রেললাইন
ময়মনসিংহ ব্যুরো

ময়মনসিংহে লক্কড়ঝক্কড় রেললাইন

ঈশ্বরগঞ্জ রেললাইন পরিদর্শনে আনসার সদস্যরা

ময়মনসিংহ-ভৈরব রেলপথে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ২৪ কিলোমিটারজুড়ে আছে নানা ত্রুটি। এ রুটে প্রতিদিন জামালপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিজয় এক্সপ্রেস ও নাসিরাবাদ নামে দুটি ট্রেন চলাচল করে। তবে এগুলো চলছে ঝুঁকি নিয়ে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে কম গতিতে। রেলে নাশকতা ঠেকাতে গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার অভ্যন্তরের রেলপথকে ১২টি অংশে ভাগ করে প্রতি দুই কিলোমিটার এলাকার জন্য আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হয়। ৬৮জন সদস্য পালাক্রমে দিনরাতে রেলপথের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন।

 


আনসার সদস্যরা দেখতে পান, এলাকায় নানা স্থানে ট্রেন চলে হেলেদুলে। অনেক স্থানে নেই স্লিপারের ক্লিপ, ফিশপ্লেটে নাট নেই, ডগপিন নেই-এমনকি স্লিপারও নেই। সমকালের অনুসন্ধানেও দেখা গেছে এমন করুণ পরিস্থিতি। বেহাল এই রুট চোখে আঙুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দেয় সারাদেশে রেলের অব্যবস্থাপনার চিত্র।

 


এ রেলপথ অনেকটা অবহেলিত বলেই মনে করেন এলাকার লোকজন। রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। রেলপথের নানা ত্রুটি শনাক্ত করে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি দপ্তর। তাদের তৈরি তালিকা অনুযায়ী ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা অংশে রেলপথের স্লিপারে নেই ৮ হাজার ক্লিপ, ফিশপ্লেটে নাট নেই ১৪২টি, ডগপিন নেই ১৫৮৭টি, স্লিপার নেই ১৬টি এবং ৬৯টি স্লিপার ভাঙা।

 


আনসার সদস্যরা ত্রুটির বিষয়ে প্রথমে উপজেলা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তাকে জানানোর পর গত বৃহস্পতিবার পুরো এলাকার ত্রুটি শনাক্তে কাজ করেন তারা। তাদের প্রতিবেদন উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা সুশান্ত মোদক ঈশ্বরগঞ্জ স্টেশন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়েছেন।

 


আনসারের তৈরি প্রতিবেদন সরেজমিন খতিয়ে দেখে জানা যায়, সম্প্রতি সোহাগী স্টেশন থেকে নয়শিমুল মোড় পর্যন্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়। নয়শিমুল মোড় থেকে হাটুলিয়া রেল সেতু পর্যন্ত স্লিপারে ক্লিপ নেই ২৫৫টি, ৪০ জোড়া ফিশপ্লেটে নাট নেই ৩৫টি, ৮০টি কাঠের স্লিপারে ডগপিন নেই ১৬৮টি, স্লিপার নেই ৩টি, হাটুলিয়া সেতু থেকে সোহাগী স্টেশন পর্যন্ত স্লিপারে ক্লিপ নেই ৮২০টি, ফিশপ্লেটে নাট নেই ৩১টি, ডগপিন নেই ২৯৫টি, ৭টি স্লিপার ভাঙা।

 

সোহাগী এলাকায় দায়িত্বে থাকা আনসার দলনেতা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, স্টেশন এলাকায় স্লিপার ভেঙে লাইন কিছুটা দেবে যাওয়ায় ট্রেন চলার সময় ঝাঁকুনি হয়। বিভিন্ন স্থানে নেই ক্লিপ, নাট। এসব রেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আসছেন তারা। তারা দায়িত্ব পালন শুরু করার আগে থেকে এই অবস্থা।

 


ঈশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকার নয়শিমুল থেকে হাটুলিয়া রেল সেতু পর্যন্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের একজন আবদুল জলিল। তিনি বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর সঠিকভাবে তারা তদারকি করছেন। লাইনের ত্রুটি আগে থেকেই ছিল। তারা দায়িত্ব পালন শুরুর পর কোনো কিছু চুরি হয়নি লাইন থেকে।

 


ঈশ্বরগঞ্জ স্টেশন এলাকায় বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়– স্লিপারে নেই ক্লিপ, ফিশপ্লেটে চারটি নাটের স্থলে আছে তিনটি। সেখানে কথা হয় রেলওয়ে ট্রাফিক শাখার সাবেক পয়েন্টসম্যান আক্তার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, লাইনটি অন্তত ৮ বছর আগে মেরামত করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে মেরামত না হওয়ায় অনেক স্থানে জরাজীর্ণ অবস্থা। অনেক ক্লিপ, নাট খুলে নিয়ে গেছে। অবিলম্বে মেরামত করা দরকার।

 


উপজেলা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা সুশান্ত মোদক বলেন, আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালনকালে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায় তাদের ওপর বর্তাতে পারে। তাই রেলপথের ত্রুটি চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হয়েছে। রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরেও প্রতিবেদনটি পাঠানো হচ্ছে।

 


ঈশ্বরগঞ্জ স্টেশন অফিসার মো. মিজানুর রহমান বলেন, আনসার সদস্যদের তৈরি প্রতিবেদনটির বিষয় সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো হয়েছে। লাইনের বিভিন্ন জায়গায় ক্লিপ, স্লিপার ও অন্যান্য জিনিস না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই ট্রেন চলাচল করছে। এগুলো সংস্কার করা হলে ট্রেন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারবে।

 


এ রুটে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা পর্যন্ত ঈশাখাঁ এক্সপ্রেস এবং ভৈরব পর্যন্ত দুই জোড়া ট্রেনও চলাচল করত। করোনাকালে ট্রেনগুলো বন্ধ হওয়ার পর আর চালু হয়নি। এ নিয়েও আছে এলাকার মানুষের ক্ষোভ।

 

 

হাটুলিয়া এলাকায় কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল বারেক ও রতন মিয়ার সঙ্গে। বৃদ্ধ আবদুল বারেক বলেন, পাকিস্তান আমলে রেলের নিরাপত্তা লাগেনি। এখন নিরাপত্তা দিতে হচ্ছে। ট্রেন চলাচল কমে যাওয়ায় লাইনটির জীর্ণ অবস্থা। বন্ধ ট্রেনগুলো চালু হওয়া দরকার। এতে এলাকার মানুষ উপকৃত হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।

 

 

অনুসন্ধানের সময় সোহাগী স্টেশনের কাছে রেললাইনের পাশে মাটি পরীক্ষা করতে দেখা যায় একটি দলকে। এই দলের প্রকৌশলী জুনাইদ হাসান বলেন, রেলপথে ডাবল লাইন স্থাপনের জন্য মাটি পরীক্ষার কাজ তাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। কিছুদিন ধরে তারা ময়মনসিংহ থেকে ভৈরব রেললাইনের বিভিন্ন স্থানে মাটি পরীক্ষা করছেন।

 

রেলওয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ময়মনসিংহ থেকে ভৈরব পর্যন্ত রেলপথ ডাবল লাইন করার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। সে জন্যই মাটি পরীক্ষা করা হচ্ছে। ডাবল লাইন স্থাপন করে ময়মনসিংহ থেকে ভৈরব হয়ে সিলেট পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হতে পারে।

 

রেলওয়ের ময়মনসিংহের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী আকরাম আলী বলেন, ‘লাইনগুলো অনেক পুরোনো। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি লাইন মেরামত করে ভালো করার জন্য। কিন্তু এটি এক দিনে সম্ভব নয়। আমরা কারিগরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রেখেছি। তার পরও যে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না, তা নয়।’

 

তিনি আরও বলেন, স্লিপারের ক্লিপ যেন চুরি না হয়, সে জন্য ওয়েল্ডিং করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহ-ভৈরব রেলপথেও এ কাজ করা হবে।

 

ভোরের আকাশ/ সু