দেশে প্রায় ১২৩ প্রজাতির মশা আছে। ঢাকায় ১৬ প্রজাতির মশা বেশি দেখা যায়। এরমধ্যে কিউলেক্স মশা ৯০ শতাংশ। এরপরের অবস্থানে এডিস, অ্যানোফিলিস, আর্মিজেরিস, ম্যানসোনিয়া এবং অন্যান্য মশা। তবে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কিউলেক্সর পরিমাণ বাড়তে থাকে। এই সময় কিউলেক্স ৯৫ থেকে ৯৯ শতাংশ হয়ে যায়। এখন ঢাকায় ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদরা।
তাদের মতে, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা বিস্তার লাভ করেছে সারা বছর। পাশাপাশি অক্টোবর থেকে কিউলেক্সের উপদ্রব বেড়েছে। চলতি ও আগামী মাসে এর উপদ্রব আরও বাড়বে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
কীটতত্ত্ববিদরা জানান, এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক হওয়ায় মানুষ অতি সতর্ক থাকেন। কিন্তু কিউলেক্সের ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। দেশের ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ মশার এই প্রজাতি ফাইলেরিয়া বা গোদরোগের জীবাণু বহন করে। এছাড়াও কিউলেক্স মশার কামড়ে চর্মরোগও হয়ে থাকে। আর এই মশার ‘গুন গুন’ শব্দ ও কামড় অস্বস্তিকর । বেশি উপদ্রবের সময় স্বস্তিতে কোনো কাজ করতে পারে না মানুষ। নগরবাসীকে রোগ-ব্যাধি ও অস্বস্তি থেকে পরিত্রাণ দিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
কীটতত্ত্ববিদ ও মশা বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। বছরজুড়ে তিনি মশার প্রজনন নিয়ে গবেষণা করেন। এজন্য তিনি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মশা ধরার ফাঁদ পেতেছেন। প্রতি মাসে তিনি মশার প্রজননের চিত্র বিশ্লেষণ করেন। ডিসেম্বরে তার পর্যবেক্ষণ বলছে, অক্টোবরের শুরুতে সপ্তাহে গড়ে ২০০টি মশা ধরা পড়ত। নভেম্বরে গড় সংখ্যা একই রকম ছিল। তবে ডিসেম্বরে ফাঁদগুলোতে মশা ধরা পড়ার গড় বেড়ে দাঁড়ায় ২৫০টি। আর জানুয়ারিতে ফাঁদগুলোতে মশা ধরা পড়ার গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০টি। কিউলেক্স প্রজননের গড় বৃদ্ধি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি ও মার্চে কিউলেক্সের প্রজনন অনেক বেশি হবে। এজন্য ডোবা, নালা পরিষ্কার করে সেখানে মশার লার্ভা নিধনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ গবেষক দলবদ্ধভাবে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তারা জানান, গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির যাত্রাবাড়ী, ঢাকা উত্তর সিটির দক্ষিণখান ও উত্তরার দুটি স্থান থেকে। পাশাপাশি সাভার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফাঁদ পেতে গবেষণার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসব স্থানের মধ্যে জানুয়ারিতে উত্তরার ফাঁদে গড়ে ৪০০ মশা আটকা পড়ে। এরপরে রয়েছে মিরপুর ও দক্ষিণখান। যাত্রাবাড়ীর ফাঁদে অপেক্ষাকৃত কম মশা ধরা পড়ে।
কোথায় কিউলেক্স জন্মায় : দূষিত ও বদ্ধ জলাশয়গুলো মূলত ঢাকার কিউলেক্স প্রজননের প্রধান উৎস স্থল। ঢাকায় সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার বদ্ধ নর্দমা, খাল, ডোবা ও নদী। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর দূষিত পানিতে বিপুল পরিমাণ কিউলেক্স মশার প্রজনন ঘটছে এমন তথ্য কীটতত্ত্ববিদদের।
জানতে চাইলে কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরীর মতে, সিটি করপোরেশন কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। যখন যে কাজ করা দরকার, সেটা করে না। যেভাবে করা দরকার, সেভাবে করে না। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে মানুষকে জেল-জরিমানা করে হয়রানি করে থাকে। তিনি জানান, কিউলেক্স মশার ৯৫ ভাগ প্রজনন উৎস ডোবা, নালা ও জলাশয়। এসবের বেশিরভাগের মালিকানা সরকারি সংস্থার। সিটি করপোরেশনকে নেতৃত্ব দিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। সিটি করপোরেশনকে অনেক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, তারা কোনো কিছু শোনেন না।
দুই সিটির তৎপরতায় কমছে না মশা : দায়িত্ব প্রাপ্ত সংস্থা ঢাকার দুই সিটির তৎপরতায় কমছে না মশা। বছরজুড়ে বিস্তার লাভ করা ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সংস্থার ব্যর্থতা সবার কাছে পরিষ্কার। কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ এ খাতে বছরে শত কোটি টাকার বেশি জনগণের রাজস্ব খরচ করছে সংস্থা দুটি।
দুই সিটির দাবি, প্রতিদিন সকাল ও বিকালে মশা নিয়ন্ত্রণে তারা কীটনাশক ব্যবহার করছেন। লার্ভা নিধনে সকালে কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। আর বড় মশা নিধনে বিকালে ফগিং করা হচ্ছে। তবে এ কার্যক্রম যথাযথভাবে করা হচ্ছে না বলে অভিমত কীটতত্ত্ববিদদের। তাদের মতে, মশা নিয়ন্ত্রণ একটি বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ। প্রজনন মৌসুম বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু, দুই সিটির কার্যক্রমে তার বড়ই ঘাটতি রয়েছে।
জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বার ও কীটতত্ত্ববিদ ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণ কাজ সঠিক নিয়মে চলছে না। এটা বারবার বলা হলেও তারা মানতে নারাজ। নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো কাজ করছে। এতে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
তিনি বলেন, দূষিত পানি ও বদ্ধ জলাশয়ে কিউলেক্সের প্রজনন ঘটে। ঢাকায় তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গায় প্রচুর কিউলেক্স মশার জন্ম হচ্ছে। এরসঙ্গে রয়েছে, দুই সিটির বদ্ধ নর্দমা ও নগরীর অপরিষ্কার জলাশয়গুলো। কিউলেক্স মশার এসব উৎস বন্ধে কর্তৃপক্ষকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
দুই সিটি কি করছে ? : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে সামছুল কবির রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ডিএসসিসি। ডোবা, নালা ও অন্যান্য উৎসে মশার প্রজনন রোধে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব তৎপরতার কারণে কিউলেক্স মশার প্রজনন এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। চলতি মাস, আগামী মাসেও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার জনমনে আতঙ্ক তৈরির জন্য প্রতিবছর তার গবেষণা প্রকাশ করেন। বাস্তবে তা সত্য হয় না। গতবছরও হয়নি, এবারও হবে না। তার কাজ আতঙ্ক সৃষ্টি করা তিনি তাই করছেন, আমাদের কাজ নগরবাসীকে স্বস্তি দেওয়া। আমরা সেই কাজ করে যাচ্ছি।’
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, কিউলেক্স মশার উপদ্রব বন্ধে ডিএনসিসির তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। প্রয়োজনে তৎপরতা আরও বাড়ানো হবে।
মশা রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষের কাছে এখন বড় আতঙ্কের নাম। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে মারা গেছেন ১ হাজার ৭০৫ জন। এরমধ্যে ঢাকার ৯৮০ জন ও ঢাকার বাইরের ৭২৫ জন। চলতি বছরে ইতোমধ্যে মারা গেছেন ১৫ জন, এরমধ্যে ঢাকার ৯ জন ও ঢাকার বাইরের ৬ জন। ঘুম কেড়ে নেওয়া ডেঙ্গুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিউলেক্স মশাও। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা নানা আশ্বাসের কথা বললেও বাস্তবে মশার উপদ্রব থেকে নিস্তার মিলছে না।
ভোরের আকাশ/মি