ময়মনসিংহে আশঙ্কাজনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামেও বিকিকিনি হচ্ছে। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠালে কিছুদিন পর আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আবারও মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তবে সবসময় চুনোপুঁটিরা আইনের আওতায় এলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে মাদক কারবারি রাঘববোয়ালরা।
পড়াশোনা শেষ করে তরুণ-যুবকদের অনেকে চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে যোগ দিলেও দিনের পর দিন নানা চেষ্টা করেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না অনেকের। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেকারের তালিকা দীর্ঘ হওয়ায় এসব তরুণ-যুবকের মধ্যে অনেকেই মাদকাসক্তে জড়িয়ে পড়ছে। হাতের কাছে মাদক পাওয়া যাওয়ায় স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষার্থীও মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে।
মাদকের টাকার জন্য মা-বাবার ওপর অত্যাচারের ঘটনাও ঘটছে। পরে বাধ্য হয়ে বাবা-মা সন্তানকে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে। মাদকের প্রভাবে শুধু পরিবারে অত্যাচার নয়, বহু কিশোর-তরুণ খুন-ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বসে নেই নারীরাও। অভাব-অনটনের মধ্যে থাকা অনেক নারী ভদ্রবেশে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। আবার অনেকে মাদক কারবারী স্বামীকে সহায়তা করতে এ পথে পা বাড়াচ্ছেন। এরপর সময়ের পরিক্রমায় নিজেও মাদক সম্রাজ্ঞী বনে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ঈদুল ফিতরের দিন ময়মনসিংহ নগরীতে এক রিকশাচালক ও এক ইজিবাইকচালককে খুন করেছিল ৩ কিশোর। মাদকের টাকার জন্য কিশোরদের দলটি দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ওই তিনজনের মধ্যে দুজন নগরীর দুটি কলেজের শিক্ষার্থী ছিল।
গত ২৬ মে ভালুকার কিশোর গ্যাং অনিক গ্রুপের প্রধান রেজওয়ান মাহমুদ অনিককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এক তরুণকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাব কিশোর গ্যাংয়ের একটি ভিডিও পেয়েছিল।
ভিডিওতে দেখা যায়, মাদক গ্রহণ ও উল্লাস করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করে তারা। ৯ জুন নগরীর আর কে মিশন রোড এলাকার বাসায় রামিম ইয়াবা কেনার টাকার জন্য মা-বাবাকে মারধর করে। প্রায়ই এমন করত সে। পরিবারের সদস্যরা তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য শেষ পর্যন্ত স্থানীয় একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে পাঠায়।
সূত্র আরও জানায়, মাদক গ্রহণে ইয়াবা সবার পছন্দের মধ্যে থাকলেও বিত্তবানরা মাদক হিসেবে হেরোইন গ্রহণ করে। ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ নামক আঠালো পদার্থ স্থানীয়ভাবে ‘ড্যান্ডি গাম’ নামে পরিচিত। জুতা মেরামতে ব্যবহারের এই গামকে মাদক হিসেবে গ্রহণ করছে অনেকেই। ময়মনসিংহে মূলত কক্সবাজার-চট্টগ্রাম এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকা থেকে নান্দাইল হয়ে মাদক প্রবেশ করে। ঢাকা থেকে ভালুকা উপজেলা দিয়েও ময়মনসিংহে মাদক আসে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে হেরোইন ছড়িয়ে দেয়া হয় শেরপুর থেকে। ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করা ফেনসিডিল বিভিন্ন কৌশলে ট্রাক অথবা বাসযোগে নিয়ে আসা হচ্ছে।
বিভিন্ন সময় জেলার বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে আইস, ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিল, নেশাজাতীয় ট্যাবলেট ও ইনজেকশন, দেশি-বিদেশি মদ উদ্ধার করছে। গত বছরের আগস্টে প্রায় ৮০ লাখ টাকা মূল্যের মাদকদ্রব্য ধ্বংস করে ময়মনসিংহের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। যার মধ্যে ছিল ৪ হাজার ৬০৫টি ভারতীয় মদের বোতল, এক হাজার ১২২টি ভারতীয় ফেনসিডিল এবং বিপুল পরিমাণ গাঁজা ও ইয়াবা। বুলডোজার চালিয়ে ধ্বংস করা হয় এসব মাদকদ্রব্য। শেরপুর ও ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করার সময় এসব মাদক জব্দ করা হয়েছিল। তবুও থেমে নেই মাদক কারবারি চক্র। ফলে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক, বাড়ছে মাদকসেবী।
মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসা দেয়া এবং সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র অপ্রতুল। জেলায় মোট ১৭টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে দুটি ২০ বেডের, বাকিগুলো ১০ বেডের। তবে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মাদকসেবী রয়েছে কেন্দ্রগুলোতে। অন্তত আড়াইশ মাদকসেবী এসব কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছে।
নগরীর মাসকান্দা এলাকায় অবস্থিত দীপ মাদকাসক্ত ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আরিফ সিদ্দিকী সুমন বলেন, ‘বিভিন্ন মাদকসেবীকে আমাদের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে।’
বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নাসিরাবাদ কলেজের অধ্যাপক মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘মাদক কারবারি চক্রগুলো কিশোরদের টার্গেট করে বিপথে নিচ্ছে। মাদক থেকে ফিরিয়ে আনতে সচেতনতার বিকল্প নেই।’
তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে উল্লেখ করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান ডা. কাউসার আহমেদ বলেন, ‘মাদকের টাকার জন্য বাবা-মায়ের সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ করায় অনেককে আমাদের কাছে নিয়ে আসা হয়। মাদক থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে হবে। এ জন্য শুধু চিকিৎসা দিয়ে নয়, মাদক গ্রহণের প্রবণতা রোধে বাড়াতে হবে সামাজিক সচেতনতা।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ খোরশিদ আলম জানান, ১৭ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণরাই মাদক সেবন ও কারবারে বেশি জড়িত। এ অঞ্চলে তরুণরা ইয়াবা, হেরোইন ও ইনজেকশন সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করে। অন্যান্য মাদকের ব্যবহার কম। যারা মাদকে আসক্ত তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং নতুন করে কেউ যেন মাদক গ্রহণ না করে সে নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
ভোরের আকাশ/ সু