পবিত্র রমজান শুরু হতে বাকি প্রায় এক মাস। তবে এখন থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ভেজাল উপাদান দিয়ে রমজানের জন্য ক্ষতিকর খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছে তারা। তাদের কেউ কেউ বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশাচ্ছে খাবারে। কেউ আবার মানবদেহের জন্য সর্বনাশী রং, কাঠের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করছে মসলা। অনেকে খাবার তৈরিতে ব্যবহার করছে মেয়াদোত্তীর্ণ ঘি। নামকরা প্রতিষ্ঠানে মিলেছে পচা মিষ্টিও।
কেউ কেউ আবার খাবার তৈরিতে অনায়াসে ব্যবহার করছে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ, কিডনি রোগ সৃষ্টিকারী হাইড্রোজও। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক জেনেও অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে উৎপাদন করা হচ্ছে নানা খাদ্যপণ্য। এভাবে ভেজাল উপাদান দিয়ে ক্ষতিকর খাদ্যপণ্য তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছে চট্টগ্রামের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এতে জনস্বাস্থ্য পড়ছে হুমকির মুখে।
দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, চট্টগ্রামের বেশির ভাগ বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁয়ও অস্বাস্থ্যকর, নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশে খাবার তৈরির প্রমাণ মিলছে। সরকারি কয়েকটি সংস্থাও এমন তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে। এ ধরনের কারবারে লাভ বেশি হওয়ায় শহর থেকে তা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামগঞ্জেও।
ভোক্তা সংগঠন ক্যাব বলছে, প্রশাসনের সঠিক তদারকির অভাবে এমন বেপরোয়া আচরণ করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে প্রশাসন বলছে, রমজানে ভেজাল ও ক্ষতিকারক খাদ্যপণ্য উৎপাদন এবং বিক্রি ঠেকাতে শিগগিরই বাজার মনিটরিং কার্যক্রম শুরু করা হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাই এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন করা খাদ্যপণ্য চট্টগ্রাম মহানগরের পাশাপাশি জেলার ১৫ উপজেলায় যায়। প্রত্যন্ত এলাকার ছোট-বড় অনেক ব্যবসায়ী এবং অনেক সাধারণ ক্রেতা পছন্দের পণ্যটি কিনতে ছুটে আসেন এখানে। তবে বৃহৎ এই দুই ব্যবসায়ীপাড়ায় রমজানকে টার্গেট করে বাড়তি মুনাফার লোভে কিছু ব্যবসায়ী খাদ্যে ভেজাল দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।
চাক্তাই এলাকার মিয়াখান নগর ব্রিজের পাশে বাচ্চু মিয়ার মসলা কারখানায় দিন-রাতে সমানতালে ভেজাল মসলা তৈরি করা হচ্ছিল। জরাজীর্ণ একটি টিনশেডের কারখানায় চলে মরিচ, ধনিয়া ও হলুদ গুঁড়া তৈরির কর্মযজ্ঞ। ক্ষতিকর রং, কয়লা, কাঠের গুঁড়া এবং অত্যন্ত নিম্নমানের ভুসি দিয়ে এখানে তৈরি হচ্ছিল মরিচ ও হলুদের গুঁড়া। রং, কয়লা, কাঠের গুঁড়া এবং ভুসি মিশিয়ে মসলাও তৈরি করে বিক্রি করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে। এগুলো পাঠানো হয় চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে ক্ষতিকর খাদ্যপণ্য তৈরি করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। হাতেনাতে এর তথ্যপ্রমাণ পাওয়ায় চলতি মাসের শুরুতে কারখানার মালিককে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। দেওয়া হয় এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড। অভিযানে ৯০০ কেজি ভেজাল মসলা জব্দ করা হয় প্রতিষ্ঠানটি থেকে।
চট্টগ্রামের একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান এগ্রো ফুড। প্রতিষ্ঠানটি খাবারে ব্যবহার করছে মেয়াদোত্তীর্ণ ঘি; মিলেছে পচা মিষ্টিও। আরেকটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান ইউনিক সুইটস অ্যান্ড বেকারি খাবার তৈরিতে ব্যবহার করছে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ। কিডনি রোগ সৃষ্টিকারী হাইড্রোজের ব্যবহারও অনায়াসে করছে তারা। এলিগেন্ট ফুডে মিলেছে অনুমোদনহীন ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশ্রিত বিস্কুট তৈরির প্রমাণ। অথচ ক্ষতিকারক জেনেও এসব বিস্কুট বাজারজাত করা হয় চট্টগ্রামসহ আশপাশের অনেক এলাকায়। সম্প্রতি ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশ্রিত ৮০ কার্টন বিস্কুট জব্দের প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করেছে প্রশাসন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাসে বাড়তি মুনাফার আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভেজাল খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাত করার পাঁয়তারা করছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে পিলে চমকানোর মতো তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি আমরা। এ জন্য বেশ কয়েকজনকে আটক করেছি। অনেককে জরিমানার পাশাপাশি দণ্ডও দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছি। দায়িত্বপ্রাপ্তদের নানা নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে। কেউ যাতে এভাবে ভেজাল সামগ্রী দিয়ে খাদ্যপণ্য তৈরি করে সাধারণ মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, ‘বেশ কিছু নামকরা প্রতিষ্ঠানও খাদ্যে ভেজালে জড়িত বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। এর সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তে আমরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছি। শিগগির একাধিক টিম বাজার তদারকি শুরু করবে। জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ ব্যাপারে ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘বিএসটিআইর অনুমোদনহীন নকল পণ্যে সয়লাব হয়ে গেছে বাজার। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান দিয়ে তারা তৈরি করছে নানা খাদ্যপণ্য। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো অভিযান চালিয়ে সামান্য জরিমানা করেই শেষ করছে দায়িত্ব। অসাধুদের বেপরোয়ার লাভের বলি হচ্ছেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত।’
ভোরের আকাশ/মি