logo
আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ১৫:৫৯
ঘরকুনো হলো কে, গম নাকি স্যাপিয়েন্স!
নিজস্ব প্রতিবেদক

ঘরকুনো হলো কে, গম নাকি স্যাপিয়েন্স!

দশ হাজার বছর আগে, হাজার হাজার প্রজাতির মতোই গমও ছিল নগণ্য এক জাতের বন্য ঘাস মাত্র। এর ফলন মধ্যপ্রাচ্যের অল্প কিছু জায়গাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। হঠাৎ করে কয়েক সহস্রাব্দ ধরে গম বিশ্বের সর্বত্র জন্মাতে লাগল। বিবর্তনের প্রাথমিক শর্তানুযায়ী, টিকে থাকার ক্ষমতা এবং বংশবিস্তারে সাফল্য হিসাব করলে, পৃথিবীর ইতিহাসে গম হচ্ছে অন্যতম সফল প্রজাতি।

 

আজ থেকে মাত্র ১০,০০০ বছর আগেও উত্তর আমেরিকার বৃহৎ সমভূমিতে (Great Plains) গমের একটা চারাও জন্মাত না। কিন্তু বর্তমান যুগে সেখানকার শত শত কিলোমিটার জুড়ে গম ছাড়া অন্য কোনো উদ্ভিদ চোখেই পড়ে না। পৃথিবীব্যাপী গমের চাষ হয় প্রায় সাড়ে ২২ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে, যা ব্রিটেনের আয়তনের দশ গুন। কিন্তু কীভাবে অগুরুত্বপূর্ণ এই ঘাসের প্রজাতিটি এতোটা সর্বব্যাপী হয়ে উঠল?

 

গম সাফল্য অর্জন করেছে নিজের সুবিধার্থে হোমো স্যাপিয়েন্সকে ব্যবহার করে। বনমানুষ গণের এই প্রজাতিটি প্রায় ১০,০০০ বছরের আগ পর্যন্ত শিকার আর সংগ্রহের মাধ্যমে বেশ আরামদায়ক জীবনযাপন করছিল। কিন্তু এরপর তারা গম চাষের জন্য অত্যধিক পরিমাণে পরিশ্রম করতে শুরু করল।

 

কয়েক সহস্রাব্দের মধ্যে, পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গমের যত্ন করা ছাড়া আর তেমন কিছু করার ফুরসত রইল না। ব্যাপারটা মোটেই সহজ ছিল না। গমের চাহিদার যেন কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। গম তার কাছে-পিঠে বড় কিংবা ছোট কোনো রকম পাথরই পছন্দ করে না। আর তাই স্যাপিয়েন্স হাড় ভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে মাঠ পরিষ্কার করেছে। গম তার জন্য বরাদ্দকৃত মাটি, পানি এবং পুষ্টি উপাদান অন্য কোনো উদ্ভিদের সাথে ভাগাভাগি করতেও পছন্দ করে না। ফলে প্রখর সূর্যের নিচে মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে আগাছা তুলেছে।

 

গম যাতে অসুস্থ না হয়ে পরে, সেজন্য মানুষ পোকামাকড় আর পতঙ্গের উপর নজরদারি করেছে। ইঁদুর এবং অন্য যেসব প্রাণীরা গম খেতে ভালোবাসে তাদের বিরুদ্ধে গম খুব অসহায়। গমকে বাঁচাতে তাই মানুষ তৈরি করেছে বেড়া, দিন-রাত জেগে গমের ক্ষেত পাহারা দিয়েছে। গমের তৃষ্ণা মেটাতে মানুষকে অনবরত জলের সরবরাহ করতে হতো। সেজন্য মানুষ সেচের খাল খনন করেছে, কুয়া থেকে ভারি ভারি বালতিতে করে পানি এনে ক্ষেতে ঢেলেও দিয়েছে। গমের ক্ষুধা নিবারণের জন্য স্যাপিয়েন্স বাধ্য হয়ে বিভিন্ন প্রাণীর বিষ্ঠা যোগাড় করে, গম যে মাটিতে গজাত তাতে ছড়িয়ে দিতে হয়েছে।

 

স্যাপিয়েন্সের এত শত কর্মযজ্ঞের পরেই গমের সব চাহিদা পূরণ হতো, আর তিনি তখন লকলকিয়ে বেড়ে উঠতেন। কিন্তু মানুষের শরীর এ ধরনের কাজ করার উপযোগী হয়ে বিবর্তিত হয়নি। লাফ দিয়ে গাছে ওঠা, হরিণের পেছনে দৌড়ানোর জন্য মানুষের শরীর উপযুক্ত ছিল, পাথর পরিষ্কার কিংবা পানির বালতি টানার জন্য নয়। ফলে মানুষের ঘাড়, হাঁটু, মেরুদণ্ড এবং পিঠকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।

 

সে সময়ের মানুষের কঙ্কাল পরিক্ষা করে দেখা গেছে, কৃষকে রূপান্তরিত হবার ফলে মানবদেহে নানা ধরনের রোগ ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েছিল। যেমন, মেরুদণ্ডের হাড়ের বিচ্যুতি, বাত এবং হার্নিয়া। তার উপর কৃষিকাজ এত বেশি সময় সাপেক্ষ ছিল যে মানুষকে বাধ্য হয়ে গম ক্ষেতের আশেপাশেই স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে হলো।

 

এতে করে তাদের জীবনধারণ সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে গেল। আমরা গমকে গৃহপালিত উদ্ভিদে পরিণত করিনি, বরং গমই আমাদের গৃহে আবদ্ধ করেছে।

 

ইংরেজি ‘ডোমেস্টিকেট’ (Domesticate) শব্দটি ল্যাটিন ‘domus’ থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে ‘গৃহ’। কিন্তু এখন গৃহে বাস করছে কে? গম নয়, বরং স্যাপিয়েন্সরাই।”

 

— স্যাপিয়েন্স : ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি

 

ভোরের আকাশ/ সু