logo
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ১৬:৩৮
মাছের আঁশ যখন প্রসাধনী-বৈদ্যুতিক পণ্যের কাঁচামাল
বিদেশে রপ্তানি
আ. রশিদ তালুকদার, টাঙ্গাইল

মাছের আঁশ যখন প্রসাধনী-বৈদ্যুতিক পণ্যের কাঁচামাল

মাছে-ভাতে বাঙালির খাবারের অনন্য অনুসঙ্গ ‘মাছ’। মাছের আঁশ বা উচ্ছিষ্ট বিক্রি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি পরিবারের। ফেলে দেওয়া মাছের এ আষ্টে বা আঁশ এখন বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। মৎস্যজীবীদের মাছের আঁশের ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে।

 

জানা যায়, মাছের আঁশ বলতে সাধারণত মাছের উচ্ছিষ্ট অংশকে বুঝায়। যা সচরাচর সবাই ফেলে দেয়। কিন্তু এই মাছের আঁশের নানাবিধ আশ্চর্য্য ব্যবহার রয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকরণের পর এগুলো এখন প্রতি বছর হাজার হাজার টন রপ্তানি হয় জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে।

 

টাঙ্গাইল জেলার মাছের বড় বাজারগুলোসহ প্রায় সব বাজারেই ‘বটিওয়ালা’রা পাইকারদের কাছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে মাছের আঁশ বিক্রি করছেন। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ মাছের আঁশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। শুধু বাজার নয়, অনেকেই বাসা-বাড়ি থেকেও মাছের আঁশ বটিওয়ালারা সংগ্রহ করছেন এবং মাছ ব্যবহারকারী গৃহবধূরা বিক্রি করছেন।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাছের আঁশের বিশ্বব্যাপী নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। মাছের আশেঁ থাকে কোলাজেন। যা খাদ্য, ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিকস শিল্পে ব্যবহার করা হয়। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কোলাজেন নামক পণ্যটি বিক্রি হয়। চীন ও জাপানে এই আঁশ ব্যবহার করে ইরড়-ঢ়রবুড়বষবপঃৎরপ হধহড়মবহবৎধঃড়ৎ তৈরি করা হয়। যেগুলো দিয়ে রিচার্জেবল ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়া যায়। এছাড়া মাছের খোঁসা ব্যাটারি তৈরি, বৈদ্যুতিক পণ্য, কৃত্রিম কর্ণিয়া, মাছ ও পোল্ট্রি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

 

এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২৭ হাজার ২৭৮ মেট্রিক টন মাছের আঁশ উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশ বছরে ২০০ কোটি টাকার মাছে খোঁসা বা আঁশ রপ্তানি করে। এই পেশার সাথে প্রায় ৫ হাজার মানুষ সরাসরি জড়িত। ১০-১২ টি দেশি-বিদেশি ট্রেডার এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালায়শিয়া, থাইল্যান্ড ও চায়নাতে এসব খোঁসা প্রতি মেট্রিকটন ৩৫০ থেকে ৪৭০ ডলারে রপ্তানি করা হয়।

 

গবেষকরা জানান, মানুষের পুড়ে যাওয়া ক্ষতের চিকিৎসা, প্রসাধনী তৈরি, কোলাজেন পাউডার তৈরি, আঠা তৈরি, পোশাক তৈরি, সাজসজ্জার সরঞ্জাম তৈরি, প্রাণিখাদ্যের উপাদান হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাছের আঁশ ও এর থেকে উদ্ধৃত উপাদান ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ভারি ধাতুর দূষণ নিরসন করতে ও পানি বিশুদ্ধকরণের উপাদান হিসেবেও মাছের আঁশ ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

 

সরেজমিনে মৎস্যজীবীরা জানান, মাছের আঁশ সংগ্রহ করার পর সেই আঁশগুলো পরিষ্কার পানিতে অথবা গরম পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। তারপর রোদে শুকিয়ে ঝরঝরে করা হয়। এরপরই আঁশগুলো বিক্রির উপযোগী হয়। বছরে দুই থেকে তিন বার পাইকারদের কাছে ওই আঁশ বিক্রি করা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকাররা এসে মাছের আঁশগুলো কিনে নিয়ে যায়। প্রতি মণ আঁশ ৩ হাজার ৬০০ থেকে ৪ হাজার টাকা দরে বিক্রি করা যায়। শুধু আঁশ নয় পাইকাররা মাছের নাড়িভুঁড়িও কিনে নেয়। নাড়িভুঁড়িগুলো মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

 

মাছের জাত অনুযায়ী আঁশের দামও ভিন্ন হয়। রুই-কাতল সহ বিভিন্ন বড় মাছের আঁশের দাম একটু বেশি। আর ছোট মাছের আশেঁর দাম তুলনামূলকভাবে কম। টাঙ্গাইল শহরের বড় দুই বাজার পার্ক বাজার ও ছয়আনি বাজার থেকে ১৫-২০ জন বটিওয়ালা মাছ কাটার পাশাপাশি নিয়মিত মাছের আঁশ বিক্রি করছেন।

 

টাঙ্গাইল শহরের ছয়আনি মাছের বাজারের বটিওয়ালা সজীব। মাছের আঁশ ছাড়িয়ে চাহিদানুযায়ী টুকরা করে তিনি ভোক্তাদের দিয়ে থাকেন। এতে ভোক্তাদের কাছ থেকে প্রতি কেজিতে মজুরি হিসেবে তিনি ২০-৩০ টাকা করে নিয়ে থাকেন। তিনি প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মাছ কাটেন। কাটা মাছের আঁশ বিক্রি করে তিনি বছরে প্রায় ৩০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করছেন। প্রতিবছর ৬-৮ মণ মাছের আঁশ তিনি পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন।

 

বগুড়ার মাছের আঁশের পাইকার মো. মনির জানান, টাঙ্গাইলে প্রায় ২ বছর ধরে মাছের আঁশের ব্যবসা করেন তিনি। টাঙ্গাইল থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন সময়ে ৩-৪ টন মাছের আঁশ কিনে থাকেন। বাজার যখন ভাল থাকে তখন ১০০ টাকা কেজি দরে আঁশ কিনেন। এখন বাজার দর একটু কম প্রতিকেজি ৯০ টাকা দরে কিনছেন। রাজশাহী, কুষ্টিয়া, পাবনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে তিনি ঢাকায় বছরে ৪০ টন মাছের আঁশ বিক্রি করেন।

 

টাঙ্গাইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, মাছের আঁশের নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। ওই আঁশ দিয়ে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে জিন্টপ্যান্ট-গ্যাভার্ডিন কাপড়ের উপর এক ধরণের আঠার প্রলেপ দেওয়া হয়। যার ফলে কাপড়ের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। ক্যাপসুলের খোঁসা ও প্রসাধনী সামগ্রী তৈরিতেও মাছের আঁশ ব্যবহার করা হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাছের আঁশ নিয়ে বিভিন্ন সময় গবেষণা করে অনেকে সফল হয়েছেন। টাঙ্গাইল জেলায় মাছের সব বাজারগুলো নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। প্রতিদিন কি পরিমাণ মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হয়। তার একটা জরিপের কাজও চলছে। কাজ শেষ হলে আরো বিস্তারিত বলা যাবে।

 

ভোরের আকাশ/মি