logo
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ১৯:০৩
রিজার্ভ চুরি
তদন্তে সাবেক গভর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২ কর্মকর্তার নাম
নিজস্ব প্রতিবেদক

তদন্তে সাবেক গভর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২ কর্মকর্তার নাম

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা ঘটে। এরপর পানি গড়িয়েছে অনেক দূর পর্যন্ত। সময় অতিবাহিত হয়েছে আট বছর। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বেই চাউর হয় এই রিজার্ভ চুরির ঘটনা। কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে জনগণের গচ্ছিত অর্থ এবং দেশের সম্পদ লুটের সেই ঘটনা তদন্তে এবং রহস্য উদঘাটনে অনেক দেশের সহযোগিতা নেয় বাংলাদেশ সরকার। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও মামলা হয় ভয়ঙ্কর এই চুরির ঘটনায়। বহুল আলোচিত রিজার্ভ চুরির ওই ঘটনায় মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষের দিকে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তৎকালীন গভর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ৭৬জন বিদেশি আসামিকে শনাক্ত করেছে সিআইডি।

 

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংরক্ষণে অবহেলা ও গাফিলতির কারণে হ্যাকাররা দেশের রিজার্ভের টাকা সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরসহ ১২জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দায় পাওয়া গেছে।

 

বাকি কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন একজন নির্বাহী পরিচালক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), একজন মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে ডেপুটি গভর্নর), চারজন যুগ্ম পরিচালক (তাদের দু’জন বর্তমানে উপ-মহাব্যবস্থাপক, একজন যুগ্ম পরিচালক ও একজন অবসরে), তিনজন উপ-মহাব্যবস্থাপক (দুজন বর্তমানে জিএম) ও দুজন উপ-পরিচালক।

 

তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানের দায় সম্পর্কে তদন্তে উঠে এসেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) সার্ভার একটি সংবেদনশীল ব্যবস্থা। তা সত্ত্বেও গভর্নর সুইফটের মাধ্যমে আরটিজিএসের (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) সংযোগ করার অনুমোদন দেন এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেন। এটাকে অপরাধমূলক উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তদন্তকারীরা।

 

আরটিজিএস একটি বিশেষায়িত তহবিল স্থানান্তর ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে তাৎক্ষণিক তহবিল স্থানান্তর করা যায়। সিআইডির একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন উপ-মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমান মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকের নাম এসেছে। তার সম্পর্কে তদন্তে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর দেশের কোনো তদন্ত সংস্থাকে না জানিয়ে তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক মেজবাউল হক ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিদেশি দুটি তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন। তাদের দিয়ে ক্রাইম সিন থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের নির্দেশ দেন, যা পুরোপুরি বেআইনি কাজ। এর মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও আলামত নষ্ট হয়ে যায়।

 

রিজার্ভ চুরি চক্রের ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, চীন ও জাপানের আসামিদের ব্যাপারেও চাঞ্চল্যকর নানান তথ্য তদন্তে মিলেছে। এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এরই মধ্যে সিআইডি চার্জশিট প্রস্তুত করেছে বলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। অন্তত ৭৬ জন বিদেশি আসামিকে শনাক্ত ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করেছে সিআইডি।

 

অভিযোগপত্রে মোট কী পরিমাণ রিজার্ভ চুরি হয়েছে, কার কী ধরনের ভূমিকা, কখন কোথায় কীভাবে কী হয়েছে তার আদ্যোপান্ত রয়েছে। এজন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পূর্ণাঙ্গ ৬৩৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে। আদ্যোপান্ত ওই প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছে এ প্রতিবেদক।

 

রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনার ৩৯ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। অন্যদিকে এ ঘটনায় ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতেও মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনে করা কয়েকটি মামলা এরই মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা জানিয়ে তারা বাংলাদেশের তদন্ত সংস্থা তথা সিআইডি বারবার চিঠি দিয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে বলেও জানা গেছে।

 

এদিকে গত আট বছরে আদালতের কাছে মামলাটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ৭৫ বার সময় নিয়েছে সিআইডি। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি দিতে পারেনি সংস্থাটি। সহযোগিতা করেনি চীন ও শ্রীলঙ্কা তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা তথ্য) সংগ্রহ করা হয়েছে। ফিলিপাইন ও ভারত থেকে কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণও সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু চীন ও শ্রীলঙ্কা এ সংক্রান্তে কোনো সহযোগিতা না করায় প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা যায়নি। এরই মধ্যে ভারত ও ফিলিপাইনের কাছে যেসব আইনি পরামর্শ চাওয়া হয়েছে তারা পারস্পরিক আইনি বিষয়ে সেই জবাব দিয়েছে। এই মামলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২ জন কর্মকর্তা ও অন্তত ৭৬জন বিদেশি আসামিকে শনাক্ত ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা হয়েছে।

 

সূত্র আরও জানায়, সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের পূর্ণাঙ্গ ৬৩৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনও সংগ্রহ করা হয়েছে। বর্তমানে এই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ সিআইডির কাছে আছে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন মামলাটির দ্রুত অভিযোগপত্র দাখিল করা প্রয়োজন বলে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, এখন পর্যন্ত ফিলিপাইন থেকে মোট ১৪ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এখনো ফিলিপাইনে ৬৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ডলার আটকে আছে। এছাড়া এ ঘটনায় করা মামলার আসামিও রয়েছে সেখানে।

 

অভিযুক্ত উত্তর কোরিয়ার হ্যাকার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভসহ বিভিন্ন দেশ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ চুরির পেছনে উত্তর কোরীয় সামরিক বাহিনীর হ্যাকার গ্রুপের হাত রয়েছে বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
২০২১ সালে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, লস অ্যাঞ্জেলসের একটি আদালতে পার্ক জিন হিয়ক (৩৬), জন চ্যাং হিয়ক (৩১) ও কিম ইলের (৩১) বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনে মার্কিন বিচার বিভাগ। তারা উত্তর কোরিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা রিকনেসেন্স জেনারেল ব্যুরোর সদস্য বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

 

তাদের বিরুদ্ধে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে পার্ক জিন হিয়কের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে সনি পিকচারস হ্যাক করার অভিযোগও রয়েছে।

 

২০১৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের ফেডারেল কোর্টে এই তিন জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, এই তিনজন উত্তর কোরিয়ার সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সাইবার নিরাপত্তায় তথা হ্যাকিংয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট বলেছে, সাত বছরের বেশি সময় ধরে এই তিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা হ্যাকিং করে আসছেন। যে চ্যালেঞ্জ সিআইডির ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে হ্যাকাররা হ্যাকিং ও রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটায়। এরপর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। অর্থাৎ ঘটনার ৪১ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংক মামলা করার পর ঘটনাটি পুলিশকে জানায়। মামলাটি ৪১ দিন পর হওয়ার কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট হয়ে যায়।

 

সিআইডির পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান বলেন, ‘কয়েকটি দেশ থেকে এখনো কিছু প্রতিবেদন সিআইডির কাছে আসেনি। প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে। কাজটি দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হচ্ছে।
সিআইডির একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন উপ-মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমান মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকের নাম এসেছে। তার সম্পর্কে তদন্তে এসেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর দেশের কোনো তদন্ত সংস্থাকে না জানিয়ে তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক মেজবাউল হক ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিদেশি দুটি তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন। তাদের দিয়ে ক্রাইম সিন থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের নির্দেশ দেন, যা পুরোপুরি বেআইনি কাজ। এর মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও আলামত নষ্ট হয়ে যায়।’

 

তবে এ বিষয়ে জানতে মেজবাউল হকের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মামলাটির তদন্ত তত্ত্বাবধান করছেন সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া। মামলার অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থপাচারের মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। মামলাটি আমরা তদন্ত করছি, তদন্ত মোটামুটি অলমোস্ট ভালো পজিশনে আছে। বাংলাদেশ সরকারও চেষ্টা করছে। আর এ সংক্রান্ত নিউইয়র্কে একটি মামলা হয়েছে। নিউইয়র্কের ওই মামলার বিচারক এরই মধ্যে শুনানি শেষ করেছেন।’

 

ভোরের আকাশ/মি