সময় এখন ফাল্গুনের মাঝামাঝি। শরীয়তপুরের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ এখন কালোজিরার হালকা নীলাভ ফুলের দখলে। এই ফুলকে উপলক্ষ করে জমিগুলোর পাশেই বসানো হয়েছে সারি সারি মৌ-বাক্স। ফুলের পাপড়ির মাঝে রেণু থেকে মধু সংগ্রহ করছে মৌমাছি, আর মৌচাষিরা ব্যস্ত মৌবাক্সের পরিচর্যা আর মধু আহরণে। একদিকে ঔষধী গুণসম্পন্ন হওয়ায় কালোজিরার মধুর ভালো দাম পাচ্ছেন মৌচাষিরা। অন্যদিকে জমির পাশে মৌবাক্স বসানোয় ফলন হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। এতে খুশি স্থানীয় কৃষক ও বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মৌচাষিরা।
শরীয়তপুর জেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট মৌ খামার রয়েছে ৩০টি। প্রতিটি খামারের ৫০ থেকে ২০০টি পর্যন্ত মৌবাক্স রয়েছে। তবে অন্যসব জেলা থেকে আসা মৌচাষিদের মিলে মোট ৯ হাজার ৫৮০টি মৌবাক্স রয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলায় ১৫ হাজার কেজি কালোজিরার মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গত মৌসুমে আহরণ করা মধুর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৩৭০ কেজি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার মুলনা ইউনিয়নের অন্তত ১২টি স্থানে চলছে কালোজিরার মধু আহরণ। এছাড়াও জেলার সেনেরচর, বড় গোপালপুর, পালেরচর, জয়নগর, বিলাশপুর, নড়িয়ার চাকধ এলাকায় রয়েছে কালোজিরার আবাদ ও মৌয়ালদের বিচরণ। এসব জায়গায় মধু আহরণের জন্য সিলেট, শেরপুর, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নাটোরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মৌ খামারিরা এসে আস্তানা গেড়েছেন।
জাজিরার কয়েকটি মৌ খামারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কালোজিরা ক্ষেতের অদূরেই পেতে রাখা হয়েছে সারি সারি বেশ কিছু মৌবাক্স। একটি মৌবাক্স থেকে আরেকটি মৌবাক্সের দূরত্ব প্রায় দেড় হাত। শ্রমিক মৌমাছিরা মধু আহরণ করে মৌবাক্সগুলোর ছিদ্রপথ দিয়ে ঢুকছে জমা করার জন্য। জমা করে আবার বের হয়ে যাচ্ছে মধু সংগ্রহ করার জন্য, তারা বিরামহীনভাবে চালাচ্ছে তাদের এই মধু আহরণের কর্মযজ্ঞ। মৌচাষিরাও মৌবাক্সগুলোর দেখাশোনা করছেন।
সিলেট জেলার জৈন্তাপুর থানার চারিকাটা ইউনিয়নের নয়াখোল পূর্বগ্রাম এলাকা থেকে জাজিরা এলাকায় কালোজিরার মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন নিপা মৌ খামারের মালিক মো. শাহাবুদ্দীন। গত ৩১ বছর ধরে বিভিন্ন জেলায় মধু সংগ্রহের কাজ করে আসছেন তিনি। তবে ৫ বছর ধরে কালোজিরার মৌসুম এলে শরীয়তপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি গাড়েন তিনি। অন্যান্য মধুর চাইতে কালোজিরার মধুর দাম ভালো পাওয়ায় খুশি এই মৌচাষি।
তিনি বলেন, আমি বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে থাকি। কালোজিরার মৌসুমে আমি শরীয়তপুরে চলে আসি। এ বছর অনেক জমিতে কালোজিরার চাষ হয়েছে তাই মধুও ভালো পাচ্ছি। আমি ১৫০টি বাক্স বসিয়েছি। এসব দেখাশোনা করতে ৩ জন শ্রমিক কাজ করছে। আমার খামারে প্রতিদিন ২০ কেজি করে মধু পাচ্ছি। কালোজিরার মধুর প্রচুর চাহিদা। আমরা এই মধু ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। এতে আমরা অনেক লাভবান।
শেরপুর থেকে আসা মধু সংগ্রহকারী মারুফ আহম্মেদ বলেন, একদিন পর পর আমরা সকালে বাক্সগুলো খুলে মধু বের করে আনি। একেকটি বাক্সে সর্বনিম্ন এক পোয়া থেকে সর্বোচ্চ ৪ কেজি পর্যন্ত মধু পাই। পরে এ মধু মেশিনের মাধ্যমে বের করে বাজারজাত করার জন্য কন্টেইনারে ভরে রাখি। কালোজিরার মধুর অনেক চাহিদা, তাই দামও বেশ ভালো।
এদিকে মৌমাছির পরাগায়নের ফলে আগের তুলনায় ফলন হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। ফলে কালোজিরা আবাদে উৎসাহী হচ্ছেন কৃষকরা। তাইতো জমির পাশেই বসতে দিয়েছেন মৌ চাষিদের। স্থানীয় কৃষক ফয়সাল বেপারী বলেন, আগে যখন মৌচাষিরা আসতো তাদের জমিতে বসতে দিতাম না। আমরা আসলে বুঝতাম না জমির পাশে মৌ বাক্স বসালে ফলন ভালো হয়। আমরা মনে করতাম মৌমাছিরা ফসল নষ্ট করে ফেলে। তবে এখন আমরা বুঝি, তাই মৌ চাষিদের এখানে মধু সংগ্রহ করতে দিই। জমির পাশে মৌবাক্স বসায় জমিতে ফলন ও ভালো হচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. রবীআহ নূর আহমেদ বলেন, কালোজিরা আবাদের পর বৃষ্টি হয়ে প্রথম দিকে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষক। বর্তমানে কালোজিরার ভরা মৌসুম হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৌয়ালরা এসে মধু সংগ্রহ করে বিক্রি করছে।
তিনি আরো বলেন, কালোজিরার মধু দেহের বিভিন্ন রোগ উপশমে কাজ করে। এছাড়াও আয়ুর্বেদীতেও এটির বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এখানে আসা সকল মৌয়ালদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। ভবিষ্যতে তারা যেন আরও বেশি আসতে পারে সেজন্য তাদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে। আগামীতে জেলায় কালোজিরার আবাদ বৃদ্ধিতে আরও বেশি কাজ করবে কৃষি বিভাগ।
ভোরের আকাশ/মি