logo
আপডেট : ১৩ মার্চ, ২০২৪ ১৭:৪৮
পানির স্তর নিচে নামছে
জলাশয় ভরাটে বাড়ছে অগ্নিঝুঁকি
রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি

জলাশয় ভরাটে বাড়ছে অগ্নিঝুঁকি

ক্যাপশন: জলাশয় ভরাট করে গড়ে উঠছে বিভিন্ন প্রকল্প

শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বছরে বছরে বাড়ছে শিল্প কারখানা। বাড়ছে শ্রমিক ও জনসাধারণের বসত ঘরের প্রয়োজনীয়তা। আবার রাজধানীর কোল ঘেঁষা এ উপজেলাটি বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে ভৌগোলিক অবস্থান হলেও আবাসন কোম্পানির বালি ফেলা আর ভূগর্ভস্থ গভীর নলকূপ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। পাশাপাশি জলাশয় ভরাট করে ফেলায় অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছেন ৬ লক্ষাধিক বাসিন্দা।

 

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সরকারী পুকুরটি ২০ থেকে ৩০ ফুট গভীর। কিন্তু ১ ফুট পানিও নেই। এখন ফাল্গুন শেষে চৈত্রের আগমন হতে যাচ্ছে; তাই পানি নেই পুকুরে। এমন কারণ জানালেন স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। আবার কাঞ্চন পৌরসভার বাজার এলাকা দিয়ে ৩টি খাল, বিরাবো এলাকায় ২টি খাল, রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ছনি এলাকায় খাস জমির পুকুর, মোগলান মৌজার খাস জমির পুকুর, কায়েতপাড়ার কায়েমসাইর এলাকায় ৩টি পুকুর, গোয়ালপাড়া খাল ও পুকুরসহ ৫০টির অধিক জলাশয় ভরাট করে বালি ফেলা হয়েছে।

 

সূত্র মতে, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের জলাভূমির মধ্যে রয়েছে প্লাবনভূমি, নিচু জলা, বিল, হাওর, বাঁওড়, জলমগ্ন এলাকা, উন্মুক্ত জলাশয়, নদীতীরের কাদাময় জলা, জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত নিচু সমতলভূমি এবং লবণাক্ত জলাধার। সাধারণত যেখানেই পানি, সেখানেই মাছের আবাস। তাই মৎস্য খাতে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর মোট আহরিত মাছের দুই-তৃতীয়াংশ আসে জলাভূমি থেকে। তবে জড়িপ বলছে, বাংলাদেশের এ জলাশয় ক্রমেই ভরাট হচ্ছে। ফলে বাড়ছে পানি সংকটের আশঙ্কা।

 

স্থানীয় গোলাকান্দাইল ৫নং ক্যানেল এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর মাহমুদ বলেন, ২০২১ সালে দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায়। সেখানে সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সেজান জুস কারখানায় প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। ৭ তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচ তলার একটি ফ্লোরের কাটন থেকে হঠাৎ আগুনের লেগে একে একে ৬৪ জন প্রাণ হারায়। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আগুন নেভাতে এসে পানির উৎস খুঁজে পেতে দেরী করায় ক্ষতি বেশি হয়।

 

নারায়ণগঞ্জ জজ কোর্টের আইনজীবী রূপগঞ্জের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট মো. মাসুদ মিয়া বলেন, জলাশয় রক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে জলাশয়গুলো ভরাট করা যেতো না। উপজেলা পর্যায় এ আইন প্রয়োগে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই পানির স্তর যেমন ঠিক থাকবে তেমনি জলাশয় রক্ষা হবে।

 

সূত্র মতে আরো জানা যায়, ১৯৭৫ সাল থেকে নদী-নালা, বিল, হাওর, বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি রক্ষায় প্রথমবার আইন করা হয়। দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, রূপগঞ্জে গত ২৫ বছরে ৭০ শতাংশ জলাশয় আবাসন কোম্পানির বালির তলায় চলে যায়। এতে বাড়তে থাকে ঝুঁকি। এতে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি শহরের বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে উপজেলার তারাবো, ভুলতা, কাঞ্চন পৌর এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বর্ষায় বাড়ে ভোগান্তি আর শুষ্ক মৌসুমে সংকট হয় পানির। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রূপগঞ্জে ৪৩টি পুকুর, ২৩টি খাল ভরাটের অভিযোগ রয়েছে।

 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রূপগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সিমন সরকার বলেন, প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। কোনো ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) ৫ অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। তবে রূপগঞ্জের সমস্যাটা একদিনের নয়। বহু বছর ধরে খাল বিল ভরাট হয়ে আসছে। এসব বিষয়ে আমার জানামতে আদালতে মামলা চলমান। এদিকে ডিটেইলড এরিয়া প্লান-ড্যাপের মাস্টারপ্ল্যান এবং আইন ভেঙে জলাশয় ভরাট হয়ে আসলেও প্রশাসন যেন নির্বিকার। ড্যাপের আওতায় চিহ্নিত জলাশয়গুলো যারা ভরাট করা হলেও তাদের শাস্তির আওতায় আনার চিত্র নেই খুব একটা।

 

রূপগঞ্জের বাসিন্দা ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, ড্যাপের পরিকল্পনায় জলাভূমির বিষয় সুস্পষ্ট করা আছে। আইনগুলোও সুস্পষ্ট। কোনটি জলাধার এবং তা কীভাবে রক্ষা করা যাবে- সবকিছু বলা আছে। অথচ আমরা সুফল পাচ্ছি না।

 

পূর্বাচলে ওয়াসার দায়িত্বরত প্রকৌশলী মাহমুদুল হক বলেন, ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ২ থেকে ৩ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। এসব হিসেব করেই পূর্বাচলে কাজ চলছে। তবে শহরে ভূগর্ভের পানি নয় মেঘনা নদীর পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে।

 

রূপগঞ্জ উপজেলা স্যানিটেশন ও ওয়াটার সাপ্লাই অফিসার আয়েশা খাতুন মুন্নি বলেন, শুধু রূপগঞ্জের নয় পুরো রাজধানীতেই পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। আর রূপগঞ্জের অবস্থাতেও একই পরিবেশ।

 

ভোরের আকাশ/মি