কুষ্টিয়ার সুস্বাদু তিলের খাজার খ্যাতি অনেক। জেলার সীমানা ছাড়িয়ে কুষ্টিয়ার তিলের খাজা দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তেল, চিনি ও তিল দিয়ে তৈরি করা হয় এই খাজা। কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়ায় কয়েকটি কারখানায় সব মৌসুমে এ খাজা তৈরি হয়ে আসছে। হাতে তৈরি খাজা রাতে তৈরি হয়ে পরের দিন সকাল থেকে বাজার, বাসস্ট্যান্ড এলাকাতে বিক্রি হয়।
তবে বর্তমানে ভাটা পড়েছে এই শিল্পে, জৌলুশ হারাতে বসেছে কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী এই ক্ষুদ্র শিল্পটি। তারপরও টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন তিলের খাজা ব্যাবসায়ীরা। তিলের খাজার প্রধান উপকরণ তেল, চিনির দাম বৃদ্ধির কারণে এই ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কারখানা সংশ্লিষ্টরা, তারা বলেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এই ব্যবসার অস্তিত্ব ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
সম্প্রতি জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) স্বীকৃতি পাওয়া কুষ্টিয়ার তিলের খাজা শত বছরের বেশি সময় ধরে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তবে, নানা প্রতিবন্ধকতায় এই ক্ষুদ্র শিল্পটি বর্তমানে রুগ্ন শিল্পে পরিণত হয়েছে। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রসার ঘটছে না এই শিল্পের।
কুষ্টিয়ার তিলের খাজার নাম শোনেননি বা খাননি এমন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া দুষ্কর। দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকায় অনেক আগে থেকেই কুষ্টিয়ার তিলের খাজা স্থান করে নিয়েছে। জনপ্রিয়তার দিক দিয়েও দারুণভাবে এগিয়ে স্বল্প মূল্যের এই স্থানীয় খাবারটি। একটা সময় কুষ্টিয়া সদর ও কুমারখালী উপজেলায় এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল কয়েকশো পরিবার। হাতে তৈরি খেতে দারুন সুস্বাদু কুষ্টিয়ার এ তিলের খাজা রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের রেলওয়েস্টেশন, বাসস্টেশন ও লঞ্চঘাট সহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হতে দেখা যায়, এছাড়া কুষ্টিয়ার পর্যটন এলাকা লালন শাহের মাজার ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িতেও স্টল নিয়ে বসে আছেন এই তিলের খাজা ব্যবসায়ীরা।
যতটুকু জানা যায়, অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়া শহরে বেকারি পণ্যের জন্য পরিচিত দেশওয়ালী পাড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাল সম্প্রদায়ের মানুষ এ খাবার তৈরি করতেন। ১৯০০ সালের কাছাকাছি সময়ে তেলি সম্প্রদায়ের লোকদের মাধ্যমে এ খাবারটি প্রথম কুষ্টিয়ায় তৈরি হয়।
কুষ্টিয়ার এক খামারে কাজ করাতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তেলি সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে ভারতের অন্য অঞ্চল থেকে এখানে আনে। কৃষি পণ্য তিল থেকে তেল নিঃসরণের কাজটি করার দ্বায়িত্ব¡ পড়ে তাদের ওপর। সেই হিসেবে এই মিষ্টান্নের উদ্ভাবক সেই তেলি সম্প্রদায়।
মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে ওই তেলি সম্প্রদায়কে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ৭০ এর দশকে কুষ্টিয়া শহরের চর মিলপাড়ায় কয়েকটি তিলের খাজা তৈরীর কারখানা গড়ে ওঠে। এরপর থেকেই কুষ্টিয়ায় ধীরে ধীরে তিলের খাজার প্রসার করতে থাকে। ক্রমেই কুষ্টিয়ার তিলের খাজার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও।
সাধারণত কুষ্টিয়া জেলায় তিন ধরনের তিলের খাজা তৈরি হয়। তিল ভেদে প্রকার নির্ণয় করা হয়। তিলের খাজা তৈরীর প্রধান উপকরণ তিল ও চিনি। চুলায় চাপানো বড় লোহার কড়াইয়ের মধ্যে চিনি দিয়ে আগুনে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় সিরা। নির্দিষ্ট সময় পর নামানো হয় চুলা থেকে। হালকা ঠান্ডা হলে চিনির সিরা জমাট বেঁধে যায়। তখন শিং এর মতো দোডালা গাছের সঙ্গে হাতে টানা হয় জমাট বাধা চিনির সিরা। এক পর্যায়ে বাদামি থেকে সাদা রঙে পরিণত হলে কারিগর বিশেষ কায়দায় হাতের ভাঁজে ভাঁজে টানতে থাকেন। তখন এর ভেতরে ফাঁপা আকৃতির সৃষ্টি হয়। সিরা টানা শেষ হলে রাখা হয় পরিষ্কার স্থানে। নির্দিষ্ট মাপে কেটে তাতে মেশানো হয় খোসা ছাড়ানো তিল। এভাবেই তৈরি হয়ে গেল তিলের খাজা। পরে এগুলো প্যাকেটজাত করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশের বিভিন্ন জেলাগুলোতে। কারিগররা জানান আরো এক ধরনের তিলের খাজা তৈরি করেন। তাতে দুধের ছানা মেশানো হয়। এর উপকরণ ছানা চিনি ও তেল।
কারখানায় প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তিলের খাজা তৈরি হয়। চিনি ও তেল স্থানীয় বাজার থেকে কেনা হলেও তিল কেনা হয় চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর ও ফরিদপুর অঞ্চল থেকে। তবে ভালো মানের তিল পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়। সাধারণ তিলের খাজা ১৮০ ও স্পেশাল তিলের খাজা ৩৫০ টাকা কেজি এবং এক প্যাকেট ২০ টাকায় বিক্রি হয়। একটি কারখানায় ২৫ থেকে ৩০ জন কারিগর কাজ করে থাকেন। মালিকও কারিগরদের অভিযোগ কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা ও দেশের কয়েকটি জেলায় তিলের খাজা তৈরির কারখানা আছে। অন্য জেলায় তৈরি হলেও অনেকেই এটি কুষ্টিয়ার নাম দিয়ে বাজারে ছাড়েন।
বর্তমানে কুষ্টিয়ায় দুটি তিলের খাজা তৈরীর কারখানা আছে। এর মধ্যে জয়নাবাদ এলাকায় একটি অপরটি মিলপাড়ায়। জয়নাবাদের সবচেয়ে নামকরা ১নং নিউ স্পেশাল ভাই ভাই তিলের খাজা কারখানাটি অবস্থিত।
কারখানা মালিকের ছেলে আরিফুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি আমরা জেনেছি। কিন্তু সম্ভাবনা থাকার পরও এই ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসার ঘটছে না। আগে শতাধিক পরিবার এর সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন আমার কারখানায় কাজ করছে মাত্র ২৬-৩০ জন শ্রমিক। সার্বিক সহায়তা পেলে এ শিল্পকে আরও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো সম্ভব। সম্প্রতি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি মিললেও নানা প্রতিবন্ধকতায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না এ ক্ষুদ্রশিল্প। সম্ভাবনা সত্ত্বেও প্রসার ঘটছে না।
তিলের খাজার বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার বিসিক শিল্প নগরীর উপ-মহাব্যবস্থাপক আশানুজ্জামান বলেন, কুষ্টিয়ার এই ক্ষুদ্র শিল্পের সাথে কুষ্টিয়ার বিসিক প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে জড়িত আছে। কারখানার মালিকের সাথে সব সময় যোগাযোগ হয় আমাদের। এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা বলেন, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়াটা আমাদের জন্য গৌরবের। এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই ব্যাপারে কুষ্টিয়া বিসিক কর্তৃপক্ষের সাথেও আলোচনা হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তিলের খাজা ব্যবসায়ীদের সাথে যারা জড়িত আছেন তাদের নিয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন করেছি। এই সেমিনারে ব্যবসায়ীদের সামনে আগানোর যে বাঁধাগুলো রয়েছে সেগুলো শুনে তারপরে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। প্রয়োজনে ঋণের ব্যবস্থাও করা হবে।
ভোরের আকাশ/মি