logo
আপডেট : ৭ এপ্রিল, ২০২৪ ১৪:১৯
কমেছে শুঁটকি উৎপাদন
বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলতে না পেরে হতাশ জেলেরা
খুলনা ব্যুরো

বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলতে না পেরে হতাশ জেলেরা

ক্যাপশন : দুবলার চরে শুঁটকি প্রস্তুত করছে জেলেরা

সুন্দরবনের দুবলার চরে এবার কমেছে শুঁটকির উৎপাদন। ফলে রাজস্ব আয়ও কম হয়েছে। চলতি মৌসুমে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ।

 

জেলেরা জানিয়েছেন, মৌসুম শেষে ইতোমধ্যে ঘরে ফিরেছেন। এবার সমুদ্রে মাছ কম পাওয়ায় বিনিয়োগ করা অর্থ তুলতে না পেরে হতাশ হয়েছেন জেলেরা। দুঃখে-কষ্টে সংসার চলছে তাদের। এবার ঘরে ফেরার সময়ে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ তুলেছেন তারা।

 

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের পাশে বঙ্গোপসাগরের কোণে দুবলার চর। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে এখানে গড়ে ওঠে অস্থায়ী শুঁটকিপল্লি। সাগরতীরে কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মোহনায় জেগে ওঠা বেশ কয়েকটি চর মিলে দুবলার চর মাছের জন্য সুপরিচিত। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছিল ৬ কোটি ১৭ লাখ ২১ হাজার ৮৭১ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে দুবলায় ৪৫ হাজার ৯৭৮ দশমিক ৯৮ কুইন্টাল শুঁটকি উৎপাদনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ৪৪ হাজার ৭১৩ দশমিক ১৪ কুইন্টাল এবং রাজস্ব আয় হয়েছিল ২ কোটি ৮৭ লাখ ৯৫ হাজার ২৬২ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন ৪১ হাজার ৫৪ দশমিক ৮৮ এবং রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২ কোটি ৬৪ লাখ ৩৯ হাজার ৩৪২ টাকা। এই হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে এবার রাজস্ব কমেছে প্রায় ১ কোটি টাকা। এবার উৎপাদন কমায় রাজস্বও কমেছে। চলতি মৌসুমে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাড়ে ৫ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ।

 

কেন উৎপাদন কমেছে জানতে চাইলে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ নুরুল কবির বলেন, ‘চলতি মৌসুমে দুবলার চরে শুঁটকি উৎপাদন থেকে সাড়ে ৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। গত বছর রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৬ কোটি ১৭ লাখ ২১ হাজার ৮৭১ টাকা। এবার সমুদ্রে জেলেরা প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছ না পাওয়ায় উৎপাদন কমেছে, ফলে রাজস্বও কমেছে। মৌসুমের শুরুর দিকে এবং মাঝামাঝিতে দুই দফা ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল। এটা না হলে উৎপাদন আরও বাড়তো। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং বেশি পরিমাণ মাছ আহরণ হওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বেড়েছিল।’

 

বন বিভাগের তথ্যমতে, গত বছরের ৩ নভেম্বর থেকে বঙ্গোপসাগরের পাড়ের সুন্দরবনের দুবলার চরে শুরু হয়েছিল শুঁটকির মৌসুম। এই মৌসুম শেষ হয়েছে এ বছরের ৩১ মার্চ। টানা ৫ মাস ধরে সেখানকার চরে থেকেছেন অন্তত ২০ হাজার জেলে। সাগরপাড়ের এই চরে তাদের থাকতে হয়েছে অস্থায়ী কাঁচা ঘরে। জ্বালানি, মাছ শুকানোর চাতাল, মাচাসহ সব ধরনের কাজে সুন্দরবনের কোনও গাছপালা ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়াতে চরে যাওয়া জেলেরা সঙ্গেই নিয়ে গেছেন প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী। এ বছর থাকা ও শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য দেড় হাজার ঘর, ৬৩টি ডিপো এবং শতাধিক দোকান স্থাপন করেছিলেন জেলেরা।

 

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি মাছ আহরণের জন্য জেলেদের কাছ থেকে ১০ টাকা হারে রাজস্ব আদায় করা হয়। জেলেরা প্রতি ১৫ দিনের মধ্যে ৭ দিন মাছ আহরণ করেন। বাকি ৭ দিন সেই মাছ শুঁটকি করেন। ১৫ দিন পরপর প্রত্যেকে কী পরিমাণ মাছ আহরণ করলেন, সে হিসাবে রাজস্ব ধরা হয়।

 

খুলনার পাইকগাছার মাহমুদকাঠি এলাকার জেলে জিহাদুল ইসলাম বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে ২০ জনের টিম নিয়ে দুবলার চরে যেতে আমার খরচ হয়েছে ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে কিছু ঋণ, কিছু মহাজনের কাছ থেকে ও কিছু সুদে নিয়েছিলাম। ১৭ কর্মচারীর প্রত্যেকের বেতন ছিল ৮ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এবার জ্বালানি তেলের দামও বেশি ছিল। খাবার খরচও বেশি হয়েছে। প্রতি বছর রাজস্ব নেওয়ার সময় অনিয়ম হয়। তবে মাত্রা কম ছিল। এবার ৪ হাজারের জায়গায় ১৮ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছ পাওয়া যায়নি। মৌসুমের অনেকটা সময় বৈরী আবহাওয়া ছিল।’

 

মাহমুদকাঠি জেলে পল্লির বিশ্বজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘আর্থিক দুরবস্থা, উন্নত প্রযুক্তির সংকট রয়েছে। তার মধ্য দিয়েও আমরা সমুদ্রে গিয়েছি। নৌকা, জাল, খাবার, পানি—সব কিছু মিলিয়ে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়, যা দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুদে নিতে হয়েছে। ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বছরে ১৩ লাখ টাকা দিতে হয়। সাগরপাড়ের চরগুলোতে শুঁটকির কাজ চলাকালে পানি সঙ্কট ও চিকিৎসা সঙ্কটে থাকি আমরা। প্রতি বছরই দায়িত্বশীলদের কাছে এসব সমস্যা সমাধানের দাবি জানাই। তবে এ বছর প্রশাসন থেকে খাবার পানির জন্য ফিল্টার দিয়েছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না। রাজস্ব প্রতি বছরই বাড়ছে। আবার নির্ধারিত রাজস্বের বাইরেও অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু বাড়তি টাকা নেওয়া হলেও রসিদ দেওয়া হচ্ছে সরকার নির্ধারিত টাকার। এসব টাকা ভাগ করে নিয়ে যান বন বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও পল্লির লোকজন। তবে এবার মাছ কম পাওয়ায় লোকসান বেশি গুনতে হয়েছে আমাদের।’

 

রামনাথপুরের জেলে পাচু বিশ্বাস বলেন, ‘ধারদেনা মাথায় নিয়ে সাগরে যাই। ফিরে এসেও ধারদেনায় থাকি। আসলে আমাদের জীবনের কোনও পরিবর্তন হয় না। মাছ না পেলে দেনা আরও বাড়ে। বাপদাদার পেশা, তাই ছেড়েও দিতে পারি না। অন্য কোনও কাজ শিখি নাই, যার জন্য এখানেই পড়ে থাকতে হয়।’

 

ভোরের আকাশ/মি