logo
আপডেট : ৭ এপ্রিল, ২০২৪ ১৫:৩৬
ঈদযাত্রার ধকলের সঙ্গে যন্ত্রণা ‘গলাকাটা’ ভাড়া
অনলাইন ডেস্ক

ঈদযাত্রার ধকলের সঙ্গে যন্ত্রণা ‘গলাকাটা’ ভাড়া

একে তো ঈদযাত্রায় নানামুখী ধকল, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘গলাকাটা’ ভাড়ার যন্ত্রণা। প্রতিবছরের মতো এবারও ঘরমুখো মানুষের পকেট কাটছেন কতিপয় বাস মালিক। দূরত্ব ও বাসভেদে ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ ভাড়াও হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ মিলেছে। কোনো যাত্রী পথে নেমে গেলেও বাস কোম্পানিগুলো ঠিকই সর্বশেষ গন্তব্যের ভাড়া নিচ্ছে। অসহায় যাত্রীরা এসব অনিয়ম মেনে নিতে বাধ্যও হচ্ছেন।

 

পরিবহন মালিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ সময়ে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম ভাড়া রাখা হয়। এখন সঠিক ভাড়া রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন গন্তব্য থেকে বাস ফেরার সময় বেশির ভাগ সিটই খালি থাকছে। পাশাপাশি বিভিন্ন পয়েন্টে যানজটের কারণে ট্রিপ সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। ফলে এ ছাড়া বিকল্প নেই।

 

এদিকে ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, রাজধানীর বাস, লঞ্চ ও ট্রেন স্টেশনে বাড়ছে ঘরমুখো মানুষের চাপ। শনিবারও যাত্রীর ভিড় দেখা গেছে। তবে ময়মনসিংহ বিভাগের বিভিন্ন গন্তব্যে যারা ঢাকা ছেড়েছেন, তাদের গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তা পার হতেই দুই থেকে চার ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। এ পথের যাত্রীদের বিশেষ করে নারী-শিশু ও বৃদ্ধদের অসহনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানজট যাত্রীদের বেশ ভোগাচ্ছে। বিশেষ করে টোল প্লাজা ঘিরে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। পাটুরিয়া ফেরিঘাটেও যানবাহনের জট লেগেছে গত বৃহস্পতিবার থেকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনকে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

 

গতকাল বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি রাজধানীর গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার সত্যতা পেয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, একটি বাসের শেষ গন্তব্য ধরে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, একটি বাসের শেষ গন্তব্য চুয়াডাঙ্গার দর্শনা। অন্য সময় মাগুরার যাত্রীদের কাছ থেকে ৪৫০ টাকা ভাড়া রাখা হতো। এখন মাগুরার যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া রাখা হচ্ছে ৬৫০ টাকা। দেশের অন্য রুটের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে।


এ ধরনের অভিযোগে গতকাল বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) গাবতলীর হানিফ পরিবহনের এক কাউন্টারকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া গোল্ডেন লাইন পরিবহনের একটি বাসের নির্ধারিত রুটের বাইরে অতিরিক্ত দূরত্বে চলার কারণে মামলা করা হয়েছে। একজন যাত্রী ওই পরিবহনে বরিশালে যাওয়ার টিকিট কাটেন। তার কাছ থেকে বাসের শেষ গন্তব্য স্বরূপকাঠির ভাড়া আদায় করা হয়। ওই যাত্রী বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের কাছে অভিযোগ করলে ভ্রাম্যমাণ আদালত গোল্ডেন লাইন পরিবহনের কাউন্টারে যান। তখন দেখা যায়, বাসটির রুট পারমিট বরিশাল পর্যন্ত। এ অবস্থায় ওই বাসটির মালিকের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত রুট পারমিট না থাকার অভিযোগে মামলা করেন।

 

ওই যাত্রী জানান, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি বরিশাল যাবেন। অন্য সময় ননএসি বাসে ৫০০ টাকা ভাড়া রাখলেও গতকাল তার কাছ থেকে ৮০০ টাকা রাখা হয়। অথচ প্রতি মাসে তিনি ৫০০ টাকা দিয়েই বরিশালে যাতায়াত করেন। জানতে চাইলে টিকিট বিক্রেতা দেলোয়ার বলেন, ‘ঢাকায় ফেরার সময় বাসে পর্যাপ্ত যাত্রী থাকে না। এজন্য আগের ভাড়া নিলে তাদের লোকসান হয়।’

 

গাবতলী থেকে ছেড়ে যাওয়া মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, জীবননগর, যশোর, সাতক্ষীরা, বেনাপোলগামী প্রতিটি বাস থেকেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ পথে চলাচলকারী পরিবহনের মধ্যে পূর্বাশা, জেআর, ঈগল, দ্রুতি, গোল্ডেন লাইন, কে লাইন ও শ্যামলীর বাস রয়েছে।

 

রাজধানীর বিভিন্ন টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, আগামী বুধবার যাত্রার ননএসি বাসের যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। যে গন্তব্যের ভাড়া ৪০০ টাকা, সেটা রাখা হচ্ছে ৬০০ টাকা। যেটার ভাড়া ৬০০, নেওয়া হচ্ছে ৯০০ টাকা। এসি বাসের ভাড়াও ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেশি আদায় করা হচ্ছে।

 

সোহাগ পরিবহনের টিকিট কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, যশোরের নিয়মিত ভাড়া ৬৫০ টাকা হলেও ৭৫০ টাকায় অগ্রিম টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। কাউন্টার ম্যানেজার আসিফ দাবি করেন, যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না। বাসটি বেনাপোল পর্যন্ত যাবে, তাই বেনাপোলের ভাড়া রাখা হচ্ছে।

 

কুষ্টিয়াগামী এসবি সুপার ডিলাক্সের এসি বাসের কুষ্টিয়া যাওয়ার দুটি টিকিট কিনেছেন আসিফ ইসলাম নামে এক যাত্রী। তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে বাস ভাড়া ৯০০ টাকার বদলে ১ হাজার ২০০ টাকা নেওয়া হয়েছে।

 

একইভাবে রাজধানীর মহাখালী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও ফুলবাড়িয়া থেকে ছেড়ে যাওয়া দেশের প্রতিটি গন্তব্যের যাত্রীদের কাছ থেকে বাসগুলো বেশি ভাড়া আদায় করছে।

 

রংপুর অফিস জানায়, ঈদের অজুহাতে ঢাকা-রংপুর বাস রুটে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও বাস কর্তৃপক্ষ বলছে, চান্দুরাসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে যানজট লেগেই আছে। বর্তমান সময়ে ঢাকা থেকে রংপুর পৌঁছাতে কমপক্ষে আট ঘণ্টা সময় লাগছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে রংপুর যাত্রী মিললেও রংপুর থেকে ঢাকায় খালি গাড়ি নিয়ে ফিরতে হচ্ছে।

 

রংপুর নগরীর কামারপাড়ার ঢাকা কোচস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, শুক্রবার রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা গাড়িগুলো শনিবার সকাল ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে পৌঁছে গেছে।

 

নাবিল পরিবহনে রংপুরে আসা যাত্রী রিয়াজুল করিম বলেন, ননএসি গাড়ির ৮০০ টাকার ভাড়া ঈদ ঘিরে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা হয়েছে। যদিও সড়কে আগের মতো যানজট নেই। তবে কয়েকটি স্থানে সময়ক্ষেপণ হয়।

 

এসি (স্ক্যানিয়া) শাহ আলী পরিবহনের যাত্রী হিরেন্দ্রনাথ বলেন, ক’দিন আগেও প্রতি সিটের ভাড়া ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা, এখন নেওয়া হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ টাকা। সাধারণ এসি গাড়ির ভাড়া ১ হাজার টাকার বদলে নিচ্ছে ২ হাজার টাকা।

 

ননএসি নাবিল পরিবহনের সুপারভাইজার ইদ্রিস আলী বলেন, বিআরটিএ ননএসি গাড়ির ভাড়া (ঢাকা-রংপুর) ৮৭০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর বাইরে বেশি টাকা নেওয়ার সুযোগ কই! কিন্ত বিলাসবহুল গাড়িগুলো বেশি টাকা নিচ্ছে।

 

শাহ আলী পরিবহনের (এসি স্ক্যানিয়া) চালক নওশের আলী বলেন, রংপুরে যাত্রী নামানোর পর ঢাকায় খালি গাড়ি নিয়ে ফিরতে হয়। সে কারণে ভাড়া কিছুটা বেশি নেওয়া হচ্ছে।

 

একই ধরনের কথা বলেন হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, এসআর ট্রাভেলস, আগমনী পরিবহনসহ ঢাকা-রংপুরে চলাচলকারী বাসগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

 

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, ইতোমধ্যে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়তে শুরু করছে। মহাসড়কে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপার ও টোল আদায় স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

 

বঙ্গবন্ধু সেতুর সাইট অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ২৮ হাজার ৭১০টি যানবাহন পারাপার হয়েছে এবং মোট টোল আদায় হয়েছে ২ কোটি ৩৫ লাখ ৪৯ হাজার ৮০০ টাকা। এর মধ্যে সেতুর পূর্ব অংশে ১৬ হাজার ৪৭৪টি যানবাহন পারাপার হয়। এতে টোল আদায় হয় ১ কোটি ২৪ লাখ ১৮ হাজার ৮০০ টাকা এবং সেতুর পশ্চিম অংশে ১২ হাজার ২৩৬টি যানবাহন পার হয়। এতে টোল আদায় হয় ১ কোটি ১১ লাখ ৩১ হাজার টাকা।

 

বঙ্গবন্ধু সেতুর সাইট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল জানান, ঈদের ছুটির আগেই মহাসড়কে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। যানজট নিরসনে সেতুর উভয় অংশে ৯টি করে ১৮টি টোল বুথ স্থাপনসহ মোটরসাইকেলের জন্য চারটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে।

 

এদিকে মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার সড়ক দুই লেন হওয়ায় ও চার লেনের কাজ চলায় যানজটের শঙ্কা প্রকাশ করছেন চালকরা।

 

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ে ঢাকা-রংপুর-রাজশাহী মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়লেও যানজট নেই। ঢাকা থেকে উত্তরের ঈদযাত্রা স্বস্তির করতে সিরাজগঞ্জের ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে খুলে দেওয়া হয়েছে তিন ওভারপাস ও একটি সেতু। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী বলেন, আগে ঈদযাত্রার এসময়টাতে সেতুর পশ্চিমপাড়ে যানজট বা যানবাহনের ধীরগতি থাকলেও এবার ঢাকা-উত্তরের যাত্রীরা নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরতে পারছেন।

 

সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেট থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের বাসের ভাড়া বাড়েনি। বাসের পর্যাপ্ত টিকিট ফাঁকা রয়েছে। সিলেট-ঢাকা বাস ভাড়া সাধারণ ৭০০ টাকা। এ ছাড়া বিলাসবহুল বাসের টিকিট ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকাই রয়েছে।

 

চট্টগ্রাম অফিস জানায়, ঈদ ঘনিয়ে এলেও চট্টগ্রামের বাসস্ট্যান্ডগুলোতে যাত্রীদের তেমন ভিড় নেই। নগরের জিইসি মোড়ের দামপাড়া বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে গাড়ির দীর্ঘ সারি দেখা গেলেও নেই ফেরা যাত্রীর চাপ। উল্টো যাত্রী সংকটে বেশির ভাগ বাস সঠিক সময়ে ছাড়তে পারেনি।

 

শ্যামলী পরিবহনের টিকিট ব্যবস্থাপক আকমল হোসেন বলেন, ‘এখনও কাউন্টারে আশানুরূপ যাত্রী মিলছে না। যাত্রী না থাকায় নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়া যাচ্ছে না। বাস ভাড়াও বাড়ানো হয়নি।’

 

মহাসড়কে যানজট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চালক ইদ্রিস হোসেন বলেন, ‘এখন আগের মতো তেমন যানজট নেই। বিশেষ করে দুপুরে ও রাতের দিকে কিছুটা যানজট হয়। এর মধ্যে সীতাকুণ্ড অংশে যানজট দেখা যায় বেশি। আর ঢাকায় ঢোকার আগে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।’

 

ভোরের আকাশ/মি