logo
আপডেট : ১৭ এপ্রিল, ২০২৪ ১১:২৪
‘মান্দাখালি-রামখিলা’
সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে খাল
শেরপুর প্রতিনিধি

সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে খাল

ময়লা-আবর্জনায় খালের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে

অযত্ন-অবহেলা ও সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে শেরপুর সদর উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ‘মান্দাখালি-রামখিলা’ খাল।

 

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের আওর-বাওরা ও গাওয়া বিল হয়ে দুরঙ্গি পর্যন্ত প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকায় এ খালটি প্রবাহিত। এক সময় খাল দিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে নৌকায় করে বিভিন্ন ধরনের মালামাল পরিবহন করা হত। খালের স্বচ্ছ পানি খাল পাড়ের মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করতেন। সেচ কাজে ব্যবহার করে ফসল ফলাতেন কৃষক। সেই সঙ্গে খালের পানিতে প্রচুর মাছও পাওয়া যেত। কিন্তু এসব এখন শুধুই স্মৃতি।

 

শেরপুর পৌরসভার কামারিয়া গ্রামের স্যানিটারি মিস্ত্রি মাহমুদুল ইসলাম মামুন বলেন, ‘আওরা-বাওরা বিল থাইকা খালডা একবারে দুরঙ্গি ঠেইকা গেছে গা। যত দূর খালডা গেছে, অতদূর শুধু ময়লাই; দুর্গন্ধে বাড়িঘরেও থাকা যায় না।’

 

স্থানীয়রা বলছিলেন, রাস্তাঘাটের আধুনিকায়ন, সংস্কারের অভাব ও যথাযথ ব্যবহার না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে মান্দাখালি-রামখিলা খালের ঐতিহ্য। ময়লা আর কচুরিপানার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে স্বাভাবিক পানি চলাচল। বর্তমানে পৌরসভার ড্রেনের পানি, খাল পাড়ের বাসিন্দাদের ফেলা আবর্জনা আর পাকুড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হায়দার আলীর মালিকানাধীন ‘ওয়াহেদ অটোরাইস মিলের’ পচা পানি খালে মিশে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এখন খালটিতে মাছ পাওয়া যায় না। খাল পাড়ের বাড়িঘরের বউ-ঝিরাও গৃহস্থলির কাছে এ পানি ব্যবহার করতে পারেন না। দূষিত হওয়ায় ওই পানি ফসলের জমিতে দেওয়া হলে, ফসল নষ্ট হয়ে হচ্ছে। এমনকি, ওই বিষাক্ত পানিতে নেমে মারা যাচ্ছে হাঁস।

 

গত অর্থবছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ-এলজিইডি খালটি পুনরুদ্ধার ও সংস্কারের জন্য ভেকু মেশিন দিয়ে খনন করলেও তা কোনো কাজেই আসেনি। ‘অপরিকল্পিতভাবে’ খনন করে মাটি খালের পাড়ে রাখায়, তা আবার বৃষ্টিতে খালে নেমে গেছে বলে স্থানীয়রা জানান। খালটির দখল উচ্ছেদ ও দ্রুত খননের মাধ্যমে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা সচল করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

 

কামারিয়া গ্রামের বাসিন্দা আকাশ বলেন, ‘আগে এ খালের পানিতে গোসল করছি; মাছ মারছি। এহননা খাল নষ্ট। দুর্গন্ধের কারণে বাড়িতে থাকাও কঠিন।’

 

কামারিয়ার পাশের শেখহাটি এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েক বছর ধইরা খালের পানি দূষিত হওয়ার কারণে মাছও থাকে না। আগে ক্ষেতে সেচ দেওয়া গেছে; আবাদ হইছে। এহন আবাদে সেচ দিলে ধান নষ্ট হইয়া যায় গা।’

 

পাকুরিয়া ইউনিয়নের গণইভরুয়াপাড়া গ্রামের কৃষক হযরত আলী বলেন, ‘আগে এই খালের পানি দিয়া আমরা ভাত পর্যন্ত রাইন্দা খাইছি। অহন পৌরসভার ড্রেনের পানি আর ইউপি চেয়ারম্যান হায়দার আলীর মিল থেকে নামা পানির কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। খালের পাড় দিয়ে হাইট্টাও যাওয়া যায় না।’

 

একই গ্রামের ফরিদ মিয়া বলেন, ‘হাঁস পাললে এই পানিতে নাইমা মইরা যায় গা। হইব না? সারা খালেই মেলাডি বাথরুমের লাইন নামাইননা; বিষাক্ত হয়া গেছে।’

 

খাল পাড়ের বাসিন্দা অমিলা বেগম বলেন, ‘খালডার অবস্থা খুবই খারাপ। খালে কোনো কাম-কাইজ করুন যায় না। গরু-ছাগলরে পানি খাওয়াইন যায় না, ধোয়াইন যায় না।’

 

খালটির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাকুড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হায়দার আলী বলেন, ‘এলজিইডি গত বছর খালটি খনন শুরু করে। কিন্তু খালের মূল অংশ, যেটা দিয়ে পানি প্রবাহিত হবে সেই অংশ বাদ রেখে পেছনের দিকে কিছু খনন করে কাজ স্থগিত করে দেয়। খালটির পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার ইউনিয়নের বিশাল একটি আবাদি জমির মাঠ চাষের অনুপযোগী হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। সেইসঙ্গে নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়বে।’

 

নিজের মালিকাধীন অটোরাইস মিলের ময়লা পানি খালে যাচ্ছে, এ বিষয়ে কী বলবেন? উত্তরে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনেকেই তো খালে ময়লা ফেলে; তাই আমার মিলেরটাও যায়।’

 

শেরপুর পৌরসভার ড্রেনের লাইনের সংযোগ মান্দাখালি-রামখিলা খালে গিয়ে মিশেছে; এ প্রসঙ্গে পৌরসভার মেয়র গেলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া লিটন বলেন, ‘দ্রুতই ব্যাপারটি সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

 

শেরপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘জাইকা প্রকল্পের মাধ্যমে গত বছর খালটির ডিজাইন অনুযায়ী খনন করা হয়েছে। মান্দাখালি এলাকার ব্রিজের পাশে দুইটি অটোরাইস মিল আছে। সেগুলো থেকে দূষিত পানি ও ছাইসহ অন্যান্য আবর্জনা খালের মধ্যে ফেলা হয়; সেজন্য খালটি ভরাট হয়ে যায়। ফলে এলাকার মানুষ এ খালের সুফল পাচ্ছে না। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জেলা উন্নয়ন-সমন্বয় কমিটির সভায় এ বিষয়টি উপস্থাপন করেছি। খালটি সংস্কারের প্রয়োজন হলে আবার করে দেব।’

 

শেরপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. নূর কুতুবে আলম সিদ্দিক বলেন, ‘মান্দাখালি খালের দূষণের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

 

ভোরের আকাশ/ সু