বুধবার ভয়াবহ সেই স্মৃতির এক যুগ পূর্তি হয়। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে ধসে পড়েছিল ৯ তলা ভবনটি। ভবন ধসে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক এবং আহত হয়েছেন ২ হাজার ৪৩৮ শ্রমিক। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। এদিকে তাদের বাচ্চারা মাতৃস্নেহে বেড়ে উঠছে ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নে হোসেনপুর গ্রামে অবস্থিত অরকা হোমস নামক প্রতিষ্ঠানে।
মো. আলা-আমিন মিয়া, জিয়াদ হোসেন, সৌরভ হাসান, তাহমিনা আক্তার বীথি, সুরাইয়া আক্তার গুনে গুনে ওরা ৫২ জন। এর মধ্যে ২১ জন মেয়ে, ৩১ জন ছেলে। ওরা সবাই সাভারের রানা প্লাজা ধসে হতাহত পোশাককর্মীদের সন্তান। এদের কেউ মাকে হারিয়েছে, কেউ বাবাকে। আবার আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেছে কারও মা কিংবা বাবা। এখানকার ৩১ শিশু-কিশোরের কেউ মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তে, কেউ কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হতে আবার কারও কর্ম-সংস্থান হওয়ায় হোমস ছেড়ে চলে গেছেন। বর্তমানে ২১ জন ট্র্যাজেডি-শিশু এখানে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে ৯ জন মেয়ে, ১২ জন ছেলে।
অরকা হোমসের কার্যক্রম প্রথমে চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গায় শুরু হলেও পরে গাইবান্ধায় কার্যক্রম শুরু করে ২০১৪ সালে। জেলার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর প্রায় ৯০ লাখ টাকা ব্যায়ে গড়ে তোলা হয় তিনতলা এই হোমস। পরবর্তী সময়ে আরও একটি সম্প্রসারিত তিনতলা ভবন নির্মিত হয়। এর একটি ভবনে থাকে ছেলেরা। আর মেয়েরা থাকে তিনতলা অপর ভবনটিতে। এখানে থাকা শিশু-কিশোরের সবাই পড়াশোনা করছে পাশের মুসলিম একাডেমিতে। তাদের দেখভালের জন্য রয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক। তাদের জন্য রাখা হয়েছে গৃহশিক্ষক। রয়েছেন শরীরচর্চার শিক্ষকও। ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে। সেইসাথে খেলার মাঠ, লাইব্রেরি ও বিনোদনের ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্টরা সব সময়ই স্নেহ-মমতা দিয়ে ওদের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখার চেষ্টায় থাকেন। দেশ-বিদেশে থাকা অরকার সদস্যদের আর্থিক সহায়তায়ই মূলত হোমসের ব্যয় মেটানো হয়।
এছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক অনুদান দিয়ে আসছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই অনুদান প্রদানে বিজিএমইএ গড়িমসি করছেন বলে অভিযোগ হোমস পরিচালনা সংশ্লিষ্টদের।
গাইবান্ধার সাদল্লাপুর উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের কিশামত শেরপুর গ্রামের মো. আল-আমিন মিয়া বলে, ‘ভবনধসে মাকে হারিয়েছি। মা নার্গিস বেগম ওই ভবনের তৃতীয় তলায় অপারেটরের কাজ করতেন। ভবণ ধসের দ্বিতীয় দিন মায়ের নিথর দেহ খুঁজে পান উদ্ধারকারীরা। ২০১৬ সালে অরকা হোমসে আসি। এখানে ভালো আছি। এইচএসসি পরিক্ষা দিয়েছি। লেখাপড়া শিখে প্রকৌশলী হব, মজবুত ভবন নির্মাণ করবো। যে ভবন ধসে পড়বে কখনোই।’
মায়ের লাশ পাওয়ার আশা নিয়ে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের পাশে মামা, খালা ও নানির সঙ্গে অপেক্ষায় থাকত সাভারের ছেলে ওলি হাসান। ১৫ দিন পর তার মায়ের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। অধর চন্দ্র মডেল হাইস্কুল মাঠে পচে-গলে যাওয়া সেই লাশ দেখে প্রথমে চিনতে পারা যায়নি। পরে হাতে ধরে থাকা ব্যাগে পরিচয়পত্র আর পরনের কাপড় দেখে মাকে শনাক্ত করা হয়েছিল। সেই সময় ওলি হাসানের পাশে দাঁড়ায় ‘অরকা’। ওলি হাসানের ঠাঁই হয় প্রথমে চট্টগ্রামের অরকা হোমসে। সেখান থেকে গাইবান্ধা হোমসে আসে সে। এখানে শুধু আশ্রয় নয়, এখানে এসে ওলি পেয়েছে নতুন করে জীবন শুরু করার প্রেরণা। সুন্দর পরিবেশে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ।
তাহমিনা আক্তার বীথি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানায়, ওই ঘটনায় মা বুকে আঘাত পেয়ে ভীষণভাবে আহত হন। সেই আঘাত এক পর্যায়ে ক্যানসারে পরিণত হয়। দিনমজুর শ্রমিক বাবাও অসুস্থ। কাজ হারিয়ে আমাদের লালন-পালনে অক্ষম তিনি। অরকা হোমস আমার থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়। আমার বড়বোন ফাতেমা আক্তার মিম আমার সঙ্গে এখানে থাকতেন। বিয়ের পর মিম এখন স্বামীর সাথে সংসার করছে। আহত মা রওশন আরা বেগম মারা যান ২০২০ সালে। আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছি। ভালো আছি।
গাইবান্ধা অরকা হোমসের পরিচালক মো. জাহিদুল হক বলেন, এখানে বসবাসকারী শিশুদের লেখাপড়া শেষ করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। শিশুরা যেন বাবা-মায়ের মতো স্নেহ পায় সেজন্য সবরকমের ব্যবস্থা এখানে রয়েছে। একজন ম্যানেজার, সহকারি ম্যানেজার, কেয়ারটেকার, এক্সিকিউটিভ, নিরাপত্তা কর্মীসহ তিনজন বাবুর্চি শিশু-কিশোরদের দেখভালের জন্য হোমসে দায়িত্বপালন করছেন। এখানকার শিশুরা যেদিন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে, সেদিনই আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।
ভোরের আকাশ/মি