চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি (টপ সয়েল) কেটে চাষাবাদের অনুপযোগী করার ঘটনায় কারা দায়ী তা খুঁজে বের করতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ মঙ্গলবার এ আদেশ দেন। চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
পাশাপাশি সাতকানিয়ার যেসব কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি (টপসয়েল) কাটা হয়েছে, তা বাইরে থেকে পলিমাটি এনে ৩০ দিনের মধ্যে ভরাট করতে বলা হয়েছে। চট্রগ্রামের ডিসি-এসপিকে এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। আদেশের সময় অনলাইনে আদালতে হাজির ছিলেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সাতকানিয়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ওসি।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আজাদ। সাতকানিয়ায় কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি (টপসয়েল) কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রতিপালন না হওয়ায় ব্যাখ্যা জানতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, সাতকানিয়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ওসিকে অনলাইনে গতকাল তলব করেন হাইকোর্ট। (২৩ এপ্রিল) মঙ্গলবার দুপুর ১টায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে এ বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
সাতকানিয়ায় নির্বিচার কাটা হচ্ছে ফসলি জমির টপসয়েল। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না ফসলি জমির মাটিকাটা। রাতের অন্ধকারে যে যেভাবেই পারছে স্কেভেটর (মাটি খননযন্ত্র) দিয়ে ফসলি জমির মাটি কেটে ডাম্পারযোগে (মিনিট্রাক) ইটভাটায় সরবরাহ করা হচ্ছে। উপজেলার প্রতিটি এলাকায় সিন্ডিকেট করে মাটি কাটার মহোৎসব চলছে।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে আব্দুল মুনাফ নামের স্থানীয় একজন স্থানীয় বাসিন্দা হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে ১৯ মার্চ টপসয়েল কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এ আদেশের পরও টপসয়েল কাটা অব্যাহত থাকার বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হয়। এরপর আদালত সংশ্লিষ্টদের অনলাইনে তলব করে আদেশ দেন।
উল্লেখ্যঃ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কেরানিহাট থেকে মৌলভীর দোকান ও উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত আইন অমান্য করে এস্কেভেটর (মাটি খননযন্ত্র) দিয়ে ফসলি জমির টপসয়েল কাটা হচ্ছে। আন্দার মা’র দরগাহের পশ্চিম-দক্ষিণে, নয়াখালের পশ্চিমে শত শত ডাম্পার (মিনি ট্রাক) ফসলি জমির মাটি নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটায়। সিন্ডিকেট করে একাধিক গ্রুপ জমির মালিককে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ২০ থেকে ৩০ ফুট গভীর করে মাটি কেটে ইটভাটায় সরবরাহ করছে।
উপজেলার সবচেয়ে বেশি ইটভাটা গড়ে উঠেছে উত্তর ঢেমশা, দক্ষিণ ঢেমশা, তেমুহনী, রসুলাবাদ ও দক্ষিণ ছদাহা এলাকায়। সাতকানিয়ার পশ্চিমে বাঁশখালী সীমান্ত এলাকায় পাহাড় ঘেঁষে এওচিয়া ছুড়ামনি ও ছনখোলা এলাকায় পাহাড়ের পাশে রয়েছে ১০-১২টি ইটভাটা। সেখানে ভাটার মালিকরা পাহাড় কেটে মাটি ভাটায় মজুত করছে। প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে উপজেলার নলুয়ার বিল ও নয়াখালের পশ্চিম বিল থেকে ফসলি জমির টপসয়েল কাটছে দেদার। মাটি ব্যবসায়ীরা এক শ্রেণির দালাল দিয়ে সাধারণ কৃষককে লোভে ফেলে ফসলি জমির মাটি বিক্রিতে উৎসাহিত করছেন। আর কৃষকরা লোভে পড়ে নগদ টাকার আশায় ফসলি জমির মাটি বিক্রি করে দেন। ২০-৩০ ফুট গভীর করে মাটি কাটার ফলে ধীরে ধীরে ফসলি জমি ডোবায় পরিণত হচ্ছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের নির্মাণাধীন রেললাইন ঘেঁষে উত্তর ঢেমশা ও তেমুহনী মৌজায় একাধিক চক্র গত কয়েক বছর ধরে শত শত হেক্টর ফসলি জমির মাটি কেটে নেয়ার ফলে এক সময়ের ফসলি জমি বিশাল লেকে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতি বছর শত একর ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। যার কারণে দিন দিন আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদন ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির শিকার হচ্ছে।
উপজেলার বাজালিয়া, চরতী, পুরানগড় ও ছদাহা ইউনিয়নে স্থানীয় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পাহাড় কেটে ডোবা কিংবা ভিটে ভরাট করে বাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। অনেকে আবার পুকুর খনন ও মৎস্য খামার স্থাপনের কথা বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে আবেদন করে ফসলি জমির মাটি বিক্রি করছে। প্রশাসনের নজরদারি এড়াতে মাটি ব্যবসায়ীরা রাতের সময়কে উত্তম সময় হিসাবে বেছে নিয়েছে।
ভোরের আকাশ/মি