বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কতৃপক্ষ কতৃক সিইও নিয়োগের আবেদন না মঞ্জুর হলেও এখন পর্যন্ত যমুনা লাইফের সিইও পদে বহাল রয়েছেন খন্দকার কামরুল হাসান।
(আইডিআরএ) থেকে ২০১৩ সালে নিবন্ধন পাওয়া এ জীবন বিমা কোম্পানিটি ব্যবসা শুরু করে ২০১৪ সালে। ব্যবসা শুরুর পর এরই মধ্যে আট বছর পার করে ফেললেও কোম্পানিটি এখনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। নিবন্ধন সনদের অন্যতম শর্ত ছিল তিন বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে।
নিবন্ধন সনদের শর্ত লঙ্ঘনের পাশাপাশি কোম্পানিটি দীর্ঘদিন নিয়মিত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ খালি রেখেও আইন লঙ্ঘন করেছে। তবে সম্প্রতি কোম্পানিটির সিইও হিসেবে কামরুল হাসান খন্দকার এর অনুমোদন আবেদন না মঞ্জুর করেছে আইডিআরএ । কামরুল হাসানের শিক্ষা সনদ ভুয়া প্রমানিত হওয়ায় গত ১৯ মার্চ এ নিয়োগ অনুমোদন না মঞ্জুর করেছে কতৃপক্ষ। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কতৃপক্ষের লাইফ অনুবিভাগের পরিচালকআহম্মদ এহসানুল হান্নান স্বাক্ষরিত যমুনা লাইফের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো চিঠিতে উল্যেখ করা হয়-‘যমুনা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান খন্দকারের বিদেশী ডিগ্রীর(এমবিএ) মান বীমা কোম্পানি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা ২০১২এর ৩(ক) সংশোধিত অনুযায়ী সমতাকরন না করায় এবং তার পরবর্তীতে দুটি শিক্ষাগতার দাখিলকৃত ইবাইস বিশ^বিদ্যালয়ের সনদপত্রের বৈধতার বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) প্রত্যয়নপত্র দাখিল না করায় কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে কামরুল হাসান খন্দকার এর নিয়োগ নবায়ন আবেদন না মঞ্জুর করা হলো।
যদিও এর আগে ২০২০ সালে, কামরুল হাসান প্রাথমিক নিয়োগের অনুমোদনের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া চলাকালীন ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি ডিমড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরশিক্ষায় এমবিএ উপস্থাপন করেছিলেন। তার নিয়োগ পরবর্তীতে ২০২২ সালে অনুমোদিত হয়। ২০২২ সালের ২১ শে মার্চ যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামরুল হাসানের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না করেই তাকে সিইও পদে নিয়োগ অনুমোদন দিয়েছে আইডিআরএ। এ অনুমোদন দেন আইডিআরএর তৎকালীন চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন। কামরুলের নিয়ম বহির্ভূত নিয়োগ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে সে সময় মোশারফ হোসেন পদত্যাগে বাধ্য হন। এদিকে গত ৩০ নভেম্বর ২০২৩ কামরুল হাসানের নিয়োগের মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়। সেই হিসেবে কামরুল হাসানের সিইও পদে দায়িত্ব পালন করার কোন আইনগত সুযোগ নেই। অথচ বিমা আইন অনুযায়ী, বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ তিন মাসের বেশি খালি রাখা যাবে না। তবে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ অনুমোদন দিলে সিইও নিয়োগের জন্য আরও তিন মাস সময় পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে ছয় মাসের বেশি সিইও পদ খালি রাখার সুযোগ নেই। কোনো কোম্পানিতে সিইও পদ ছয় মাস শূন্য থাকলে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে বিমা আইনে।
নিয়ন্ত্রন সংস্থা আইডিআরএ নিয়োগ নবায়ন না মঞ্জুর করার পরও আইনের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে এখনও সিই্ও পদে একজন অযোগ্য ব্যাক্তিকে কেন বসিয়ে রাখতে হবে। এ বিষয়টি বোধগম্য নয় বলে জানিয়েছেন খাত বিশেষজ্ঞরা। একটি সুত্র বলছে যে কোন উপায়ে কামরুল হাসান খন্দকার যমুনা লাইফের সিইও পদে বহাল থাকতে চাইছেন। কিন্তু মোশারফ আমলে যে সুবিধা তিনি নিয়েছিলেন এবাওে তিনি সে সুবিধা তৈরী করতে পারছেন না।
গত ৭ নভেম্বর যমুনা লাইফের চেয়ারম্যান কামরুল হাসানকে আবার সিইও নিয়োগ অনুমোদন নবায়নের জন্য আইডিআরএ বরাবর আবেদন করে।
এ বিষয়ে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বীমা কোম্পানির শীর্ষ পদ। এই পদে নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার বিষয়ে সুষ্পষ্ট বিধিমালা রয়েছে। সে অনুসারে যোগ্যতা যাচাই বাছাই করে মূখ্য নির্বাহী নিয়োগের পূর্ব অনুমোদন দেয়ার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। তবে শীর্ষ এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক যাচাইয়ের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানির।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের শুরুতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এর বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারীর উদ্যোগে বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা-২০১২ সংশোধন করা হয়েছে। ২০১২ সালে প্রণয়ন করা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ (২০১৩ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত) প্রবিধান অনুযায়ী, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য নিয়োগ প্রার্থীকে ইতিপূর্বে কোনো বীমা কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বা এর অব্যবহিত নিম্নপদ অর্থাৎ অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ন্যূনমত ৩ বছরের অভিজ্ঞতাসহ বীমা পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞ হতে হবে। কিন্তু ২০২৩ সালে সংশোধিত প্রবিধানমালায় এসব অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করা হয়। সংশোধিত বিধিমালায় মুখ্য নির্বাহী বা অব্যবহিত নিম্নপদের জন্য অভিজ্ঞতা দুই বছর এবং সংশ্লিষ্ট বীমা ব্যবসার অভিজ্ঞতা ১২ বছর করা হয়েছে। একইসঙ্গে বিদ্যমান প্রবিধানে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়সসীমা ৪০ বছরের যে শর্ত রয়েছে সেটিও বাতিল করা হয়েছে। সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬৭ বছরের শর্ত বহাল রয়েছে।
সংশোধিত প্রবিধানমালায় মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্তে বলা হয়েছে, কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হইতে কমপক্ষে ২য় শ্রেণির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অথবা চার বৎসর মেয়াদী স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রী থাকতে হবে। গ্রেডিং পদ্ধতির ফলাফলের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা প্রযোজ্য হইবে। তবে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারীদের বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হইতে সমতাকরণ সার্টিফিকেট দাখিল করিতে হইবে।
মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা ২০১২ এর ৩(ক)’র বিধান অনুসারে, কোন ব্যক্তির কোন বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য কোন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে অন্যূন ৩ বছর মেয়াদী স্নাতক ও এক বছর মেয়াদী স্নাতকোত্তর ডিগ্রি বা ৪ বছর মেয়াদী স্নাতক ও সমমানের ডিগ্রি থাকতে হবে।
ফলে মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগের অনুমোদন লাভের জন্য কামরুল হাসান খোন্দকারের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতা কোনটিই নেই। বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা ২০১২ অনুসারে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না করলে ওই ব্যক্তি মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ লাভের অযোগ্য।
কিন্তু কামরুল হাসান খোন্দকারের শিক্ষা সনদে দেখা যায়, তিনি ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে স্নাতক পাস করেন। পরে ২০০২ সালে ভারতের ডিমড ইউনিভার্সিটি অব লক্ষ্মৌ থেকে ১ বছর মেয়াদে এক্সিকিউটিভ এমবিএ করেন তিনি। তবে বিদেশি এই ডিগ্রির মান ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে নিশ্চিত নয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।
শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতাই নয় আইন অনুসারে কর্ম অভিজ্ঞতাতেও অযোগ্য কামরুল। বীমা মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা, ২০১২ এর ৩(খ)’র বিধান অনুসারে, ইতোপূর্বে কোন বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বা উহার অব্যবহিত নিম্নপদে অন্যূন ৩ বছর কর্ম অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথচ কর্ম অভিজ্ঞতার সনদগুলোর তথ্য অনুসারে কামরুলে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদে ৩ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা নেই।
জানা যায়, বীমা কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ সংক্রান্ত বিধিমালায় শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর বাধ্যবাধকতা আছে। সংশোধিত বিধিমালায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তৃতীয় শ্রেণি নিষিদ্ধ। অথচ তৃতীয় শ্রেণিতে স্নাতক পাশ এবং ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনলাইনে সম্পন্ন এমবিএর মান নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের স্বীকৃতি না থাকলেও কামরুল হাসান খোন্দকার যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে দীর্ঘদিন ধরে সিইও পদে চাকরি করে আসছেন।