স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা একুশে পদকপ্রাপ্ত কন্ঠশিল্পী ড. মনোরঞ্জন ঘোষালের জন্মদিন আজ। তিনি আজ ৭৮ বছরে পা রেখেছেন। ১৯৪৭ সালের পহেলা মে সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার গোনালি নলতা গ্রামের এক বনেদি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ড. মনোরঞ্জন ঘোষাল।
গুণী এই শিল্পী সংগীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ২০২৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক ভোরের আকাশ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৭১ সালে তেত্রিশটি লাশের ভেতর থেকে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে নিজের শরীরে কয়েকবার চিমটি কেটে মনোরঞ্জন টের পেয়েছিলেন, তিনি বেঁচে আছেন। গত ৫৩ বছর তিনি বেঁচে আছেন হাতে, পায়ে, মুখে, চুলে মৃত্যুর নিবিড় স্পর্শ নিয়ে। আজও যখন জগন্নাথ কলেজ, জজকোর্ট ভবনের সামনে দিয়ে যান, শিহরিত হন। বারবার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চের সেই রাত, যে রাতে অবিশ্বাস্যভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছিলেন তিনি। তার নিজের ভাষায়, 'ছোটবেলায় একবার গ্রামে গিয়ে বাদুড়ের গায়ের গন্ধে শরীর গুলিয়ে উঠেছিল। একাত্তরের ৩১ মার্চের সেই রাতে যখন লাশের স্তূপের মাঝখান দিয়ে বের হয়েছিলাম, তখনও নাকে লাগে সেই বাদুড়ের গায়ের গন্ধ। এখনও বাদুড়ের গায়ের গন্ধ মাঝেমধ্যেই শরীর গুলিয়ে দেয়।'
মনোরঞ্জন ঘোষাল ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের দুঃশাসনবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সময় যোগ দিয়েছিলেন বিক্ষুব্ধ শিল্পীগোষ্ঠীতে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গুলিতে বড় ভাই রতন ঘোষাল শহীদ হন। ৩১ মার্চ সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তরুণ মনোরঞ্জন। তারপর ব্রাশফায়ারের ভেতরে ৩৩ জনের মধ্যে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মনোরঞ্জন। পরে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। পরবর্তী সময়ে মনোরঞ্জন পরিচিতি পান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে। এখনও সেই পরিচিতি নিয়েই বেঁচে আছেন ৭৮ বছর বয়সী মনোরঞ্জন ঘোষাল।
সে রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ার পর প্রথমে নরসিংদী পালিয়ে যান মনোরঞ্জন ঘোষাল। সেখান থেকে ময়মনসিংহের কলমাকান্দা, জামালপুর, নেত্রকোনা হয়ে ভারতের মেঘালয়ে প্রবেশ করেন। তার পর মেঘালয়ের স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কলকাতায় পৌঁছেন। এখানে প্রথমে কিছুদিন আকাশবাণীতে গান করার সুযোগ পান পরিচিতদের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালের ২৫ মে সম্প্রচারের শুরুর দিন থেকেই মনোরঞ্জন ঘোষাল সম্পৃক্ত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের পর দেশে ফিরেই মনোরঞ্জনকে আরও একবার বেদনায় নীল হতে হয়। স্বাধীন মাতৃভূমিতে পা রেখেই খবর পান, প্রিয় ছোট ভাই মদন ঘোষালকেও হত্যা করেছে পাকিস্তানিরা। তিনি যশোরে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। সেখানেই তাকে হত্যা করে কপোতাক্ষ নদে ফেলে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। সেই মরদেহ আর পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধে দুই ভাইকে হারানোর বেদনা নিয়ে এখনও বেঁচে আছেন মৃত্যুঞ্জয়ী শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল।
বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট কেন্দ্রীয় কমিটির সহ- সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
ভোরের আকাশ/মি