দীর্ঘ এক মাস ধরে চলছে তাপপ্রবাহ। কখনও মাঝারি, তীব্র আবার অতি তীব্র তাপমাত্রা বয়ে যাচ্ছে। আর এই তাপমাত্রায় রাজশাহী অঞ্চলের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছে কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা।

কৃষি বিভাগের মতে, অতি তাপমাত্রার কারণে বোরো ধানের পরাগায়ণ বিঘ্নিত হওয়ায় ধানে চিটা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে তা পরিমাণে খুব অল্প। এছাড়াও রবি ফসল ও সবজিতে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। অন্যান্য ফসলের উৎপাদন নিয়েও কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর জেলায় এবার বোরো ধান, মসুর, খেসারি, মুগডাল, মরিচ, চিনাবাদাম, তিল, ভুট্টা, কালোজিরা বিভিন্ন ফসল মাঠে রয়েছে। প্রখর রোদ আর অসহনীয় দাবদাহের কারণে এসব ফসলের বেশিরভাগের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।

রাজশাহী অঞ্চলের এই চার জেলায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার ১৬৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এবার উৎপাদন ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৩০ মেট্রিক টন ধান।

জমিতে পানি রাখতে না পারা, দাবদাহে ধানের থোড় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ আরও কিছু কারণে ধানের উৎপাদন কমার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। লু হাওয়া বা হিট শকে আক্রান্ত হচ্ছে মাঠের ধান। দীর্ঘদিনের বৃষ্টিহীন উচ্চ তাপপ্রবাহ থেকে এই হিট শকের সৃষ্টি। তীব্র দাবদাহের কিছু অঞ্চলে ধান কাটা শুরু হয়েছে।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বোরো ধানে হিটশক (তাপজনিত ক্ষতি) বা গরম বাতাস (৩৫ ডিগ্রি) প্রবাহ হলে ধান চিটা হতে পারে। তাই এ মুহূর্তে জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি থাকতেই হবে। না হলে উৎপাদন কমে যাবে। আম, কাঁঠাল এবং লিচু গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত (৭-১০ দিন অন্তর) সেচ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যেতে পারে। এতে ফল ঝরেপড়া কমবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া মাটিতে রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং দেয়া যেতে পারে।

এ ছাড়া বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, পটল, শসা ও ঢেঁড়শ প্রভৃতি খেতে তিন-চারদিন অন্তর সেচ দিতে হবে। অন্যদিকে পাতাজাতীয় সবজি যেমন- ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, কলমি, লাউশাক প্রভৃতি খেতে দুই-তিনদিন অন্তর সেচ প্রয়োগ করতে হবে।

তবে বোরো ধানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। কৃষকরা বলছেন, অনেক এলাকায় এখনও ধান কাটা শুরু হয়নি। আবার শুরু হলেও শ্রমিক সঙ্কট হতে পারে। এর মধ্যে অনেক জমিতে চিটা লাগতে শুরু করছে ধানে।

তানোর উপজেলার গৌরাঙ্গপুর গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান এবার চার বিঘা জমিতে করেছেন বোরো আবাদ। কিন্তু চলমান তাপপ্রবাহে জমিতে দেখা দিচ্ছে পানি শূন্যতা। এতে জমির ধান চিটা হয়ে যায় কিনা- সেই দুশ্চিন্তা নিয়ে দিন কাটছে এই বোরো চাষির।

তিনি বলেন, আগে ১ ঘণ্টা পানি দিলে একবিঘা জমি সেচ হয়ে যেত। এখন দেড় ঘণ্টায়ও সেই পানি হয় না। পানি দিতেই নাই হয়ে যাচ্ছে। রাতেও এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ সময় জমিতে পানি ধরে রাখার পরামর্শ কৃষি কর্মকর্তাদের।

কিন্তু চাষিরা জানান, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে টেকসই সেচ ব্যবস্থা। ধানের ফুল আসার জন্য সর্বোচ্চ সহনীয় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও আবহাওয়া অফিস বলছে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ওঠানামা করছে ৪০ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এ অবস্থায় ঝড় বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা চাষিদের।

নাচোল উপজেলার বেড়াচৌকি গ্রামের কৃষক আবদুল আহাদ বলেন, হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি হলে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এখন যে তাপমাত্রা, এটা এখনও তেমন কোনো ক্ষয়-ক্ষতি করে নি। এখন প্রতিদিন ধানে পানি দিতে হচ্ছে। তা নাহলে ধানের ক্ষতি হতে পারে।

রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মাহমুদুল ফারুক বলেন, প্রখর রোদে বোরো ধানের পরাগায়ণ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ব্যাহত হলে ধানের চিটা হতে পারে। তাছাড়া রবি ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা যাচ্ছে। অনাবৃষ্টি আর অধিক তাপমাত্রার কারণে ফসলের খেতে নানা রোগবালাই দেখা দিতে পারে। তবে দ্রুত বৃষ্টিপাত হলে কৃষকরা কিছুটা হলেও তাদের ক্ষতি পোষাতে পারবেন।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ফজলুল ইসলাম বলেন, দাবদাহের কারণে শস্যের ফলনে কিছুটা কমতি দেখা দিতে পারে। সেটি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। এবার বোরো ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হবে। এ ছাড়া এবার বোরো ধানের জমিতে কোনো ধরনের পোকামাকড় বা রোগবালাইয়ের আক্রমণ নেই। এতে ধানের ফলন ভালো হবে।

ভোরের আকাশ/মি