দেশের অধিকাংশ নারী সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন করে থাকেন। কিন্তু মুরগির উৎপাদন চক্রে সময় বেশি লাগা, কম ডিম পাড়া, ডিম না ফোটা, বাচ্চা মৃত্যুহার বেশি হওয়ায় দেশি মুরগি পালন অতটা লাভজনক হয়ে ওঠে না। বর্তমান বাজারে দেশি মুরগির চাহিদা থাকায় এবং বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগে বাড়ছে। তাতে বিশেষ আবাসন পদ্ধতিতে দেশি মুরগির উৎপাদন ফার্মের প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন উদ্যোক্তরা ।
মেহেরপুর সদর উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা জরিনা খাতুন, শিরিনা খাতুন, রানি খাতুসহ অনেক নারী নতুন এ পদ্ধতিতে মুরগি পালন করে সংসারের বাড়তি অর্থ যোগান দিয়ে অভাব দূর করেছেন। এ সকল নারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনেক আগ থেকেই তাদের একটা স্বপ্ন ছিল, তারা দেশি মুরগির ফার্ম করবেন। সেই স্বপ্ন পূরণে বাড়ির আঙিনায় কাজে নেমে পড়েন তারা। তাদের হাতে পর্যাপ্ত মূলধন ছিল না। বেসরকারি সংস্থার দেশি মুরগির ওপর প্রশিক্ষণে তারা অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে তারা পরামর্শ নিয়ে ছোট আকারে দেশি মুরগির বিশেষ আবাসন পদ্ধতি অনুসরণ করে খামার গড়ে তোলেন।
ফার্ম করা জরিনা খাতুন বলেন, তিনি বেসরকারী সংস্থা ডিবিএস এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে খামার গড়তে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে তাঁর খামারে ১৩০টা দেশি মুরগি রয়েছে। পরিবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তিনি বাজারে বিক্রি করছেন। এর মধ্যেই তিনি এক ব্যাচ মুরগি বিক্রি করেছেন। বাজারে প্রতি কেজি দেশি মুরগি বিক্রি হয় ৫৫০-৬০০ টাকা করে। দেশি এ সকল মুরগি বিক্রি করে আমার বেশ লাভ হচ্ছে।
ডিবিএস এর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন সরদার বলেন, বর্তমানে দেশি মুরগির তুলনামূলক স্বল্প বিনিয়োগ এবং অল্প জায়গায় লালন-পালন করা সম্ভব। বর্তমান বাজারে দেশি মুরগির দাম অনেক বেশি হওয়াতে খামারি অল্প পুঁজিতে অধিক লাভ করতে সক্ষম হয়। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর অর্থায়নে স্থানীয় দারিদ্র বিমোচন সংস্থার সহযোগিতায় মেহেরপুর সদর উপজেলায় ১২০ টিরও বেশি বিশেষ আবাসন নিশ্চিত করে আধা-বাণিজ্যিকভাবে দেশি মুরগি পালন খামার গড়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে এই দেশি মুরগি পালন করে অনেকেই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন করে স্বাবলম্বি হয়েছেন।
প্রতিটি খামারে বড় মুরগি রাখার জন্য রাত্রিকালীন ঘর, বাচ্চা মুরগি রাখার জন্য ক্রিপারসহ খাঁচা, ডিম ফুটানোর নেস্ট, বৈদ্যুতিক বাল্ব, স্প্রে জীবাণুনাশক, সাইনবোর্ড ও তথ্য বই সরবরাহ করা হয়।
দশটি দেশি মুরগির জন্য ১৫ থেকে ২০ বর্গফুট আকারের রাত্রিকালীন ঘর ও উল্লেখ্য, ৫ থেকে ১০ টি মা মুরগি হতে বাচ্চা উৎপাদন, উৎপাদিত বাচ্চার ব্রুডিং ও আংশিক বাড়ন্ত সময় পালনের জন্য ন্যূনতম ২৩-৩০ বর্গফুট(দৈর্ঘ্য ৭২ ইঞ্চি, প্রস্থ ৪৬ ইঞ্চি) আকারের ক্রিপার খাঁচা সরবরাহ করা হয়। খাঁচার ভিতর পাঁচটি প্রকোষ্ঠ থাকে এবং প্রকোষ্ঠের চারপাশে বাফার এলাকা থাকে। উক্ত প্রকোষ্ঠে মা মুরগি যাতায়াতের জন্য দরজা থাকে।
তিনি আরো বলেন, এই প্রযুক্তির উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন শিকারী প্রাণীর আক্রমণ প্রতিহত করার মাধ্যমে মুরগির বাচ্চার মৃত্যুর হার হ্রাস করা। মা মুরগির অনুৎপাদনশীলতার মেয়াদ হ্রাস করে দেশি মুরগির ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি করা। মাংস উৎপাদনে মুরগির পালনের ব্যাচ সংখ্যা বৃদ্ধি করা। সঠিকভাবে সব ধরনের কারিগরি সহযোগিতা, জীব- নিরাপত্তা, ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা, খাবার ব্যবস্থাপনা ও নিয়মিত টিকা প্রদান করার ফলে দেশি মুরগির উৎপাদন অত্র এলাকাতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতে এর গুণগতমান সমুন্নত রেখে উৎপাদনশীলতা আরো বৃদ্ধি করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
সংস্থাটির সহকারী পরিচালক জুবায়ের আলম জানান, ডিবিএস সবসময় প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি এর গুণাগতমান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই গুণাগতমান ও উৎপাদনশীলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
মেহেরপুর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার হাদিছুল আবিদ বলেন, দেশি মুরগির চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু সে পরিমাণে দেশি মুরগি উৎপাদন বাড়ছেনা। মেহেরপুরে ডিবিএস প্রাথমিক পর্যায়ে বিশেষ আবাসন পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালনের জন্য গ্রাম পর্যায়ে বেশ কিছু মহিলাদের আমাদের সহয়তায় প্রশিক্ষণ দিয়ে খামারিদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে। এ পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পোলন করলে এর বাচ্চা কম নষ্ট হয়, নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করা যার কারনে উৎপাদনও বেশি হয়। মহিলা খামারিরাও বেশ সফলতা লাভ করছেন। এ পদ্ধতিতে দেশি মুরগি চাষ প্রান্তিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশি মুরগির চাহিদা পূরণ হবে।
ভোরের আকাশ/মি