চট্টগ্রামভিত্তিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’-এ সনদ নিয়ে বাণিজ্য চলছে। প্রতিটি সনদে লেনদেন হয় অন্তত পাঁচ লাখ টাকা। আর ওই অপকর্মের ‘গুরু’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্য সচিব ও সাবেক ট্রেজারার সরওয়ার জাহান।
এমন অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘অব্যাহতিপ্রাপ্ত’ উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হক। তার দাবি, এসব অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিয়ম না মেনেই তাঁকে ‘অব্যাহতি’ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড। নগরের বায়েজিদ আরেফিননগরে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস।
এ দিকে অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হককে উপাচার্য পদ থেকে ইউজিসি আইনের কোন ধারায় অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তার ব্যাখ্যা চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। অপরদিকে সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে উঠা নানা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউজিসি গঠিত তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ও ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ডিন প্রফেসর ড. শামসুল আলম।
২০ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. মো. ফরহাদ হোসেন স্বাক্ষরিত সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বোর্ড অব ট্রাস্টির (বিওটি) চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের কাছে দেওয়া একটি চিঠিতে বলা হয়, ‘সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হককে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। উপাচার্য অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হককে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর কোন ধারা অনুযায়ী অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে এবং তাঁর পরিবর্তে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ড. শরীফ আশরাফউজ্জামানকে কেন উপাচার্যের চলতি দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’।
২০ এপ্রিল ইউজিসি’র নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বিশ্ববিদ্যালয়টির বিওটির সদস্য সচিব সরওয়ার জাহান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ শরীফ আশরাফুজ্জামানকে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘২০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই সিদ্ধান্ত সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির নীতি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী ৭৭তম বোর্ড অব ট্রাস্টির সভায় সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, যা ২১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে।’
জানা যায়, ২০২১ সালের ১৬ মার্চ অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (ভিসি) হিসেবে নিয়োগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। ওই বছরের ১ এপ্রিল তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উপাচার্য হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী বছরের ৩১ মার্চ। নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর এবং রাষ্ট্রপতিই পারবেন ভিসিকে অপসারণ কিংবা অব্যাহতি দিতে। কিন্তু মেয়াদের আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি নিয়ম বহির্ভূতভাবে অব্যাহতি দেয় তাকে।
২০২১ সালের মার্চে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কতগুলো জাল সনদ দেওয়া হয়েছে সেটি অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করেন জানিয়ে অধ্যাপক মোজাম্মেল বলেন, ‘৫০০টি স্নাতক সনদ যাচাই করে দেখতে পাই ১০৫টি ভুয়া বা জাল।’
সম্প্রতি বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টির অনিয়মের গোমর ফাঁস করে দেওয়ায় তড়িঘড়ি করে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ‘আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। ২০ এপ্রিল ট্রাস্ট্রির এক সভায় হঠাৎ করে আমাকে সভাস্থলের বাইরে যেতে বলা হয়। এর কিছুক্ষণ পরে আমাকে অব্যাহতির চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়। আমাকে হুমকি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। অথচ, আমাকে রাষ্ট্রপতি ছাড়া অন্য কেউ অপসারণ করতে পারেন না। কেবল জালসনদ ও আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার আশঙ্কায় এটি করা হয়েছে।
অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অচলাবস্থা বিরাজমান। এতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা। একজন মাত্র ব্যক্তি সরওয়ার জাহান ২০০৩ সাল থেকে ট্রেজারার ছিলেন। ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্য সচিব ও সাবেক ট্রেজারার সরওয়ার জাহান জাল সনদ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।’
সরওয়ার জাহান ট্রেজারার থাকাকালীন ২০১০ সালে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে বড় অংকের টাকা সরিয়ে নিয়েছেন উল্লেখ করে অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এক হিসাবে দেখা যায়, তিনি বিগত ১০ বছরে ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা তুলেছেন। যা ইন্টারেস্টসহ ৩ কোটির উপরে দাঁড়ায়। বিওটি জানতে চাইলে একপর্যায়ে তৎকালীন ট্রেজারার সরওয়ার জাহান বিষয়টি স্বীকার করেন যে এই টাকাগুলো একটি ব্যাংক একাউন্টে জমা আছে এবং সেখানে আর টাকা জমা রাখা হয় না।
'‘অব্যাহতি’ পাওয়া ভিসি আরও বলেন, ‘সরওয়ার জাহান একটি জায়গা থেকে ৭৫ লাখ টাকা লোন করেছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিশোধ বাবদ ২৮ লাখ টাকা তুলেও নিয়েছেন কিন্তু কেন লোন করেছেন সেটি তিনি জানাননি। এমনকি বোর্ডও সবসময় এটিকে পাত্তা দিচ্ছিল না। মিটিংয়ে এজেন্ডা দিলেও কাগজপত্র নেই, ডকুমেন্টস নেই বলে বলে কালক্ষেপণ করা হতো। এভাবে ৮-১০ কোটি টাকার যখন দুর্নীতি হলো তখন আমি আমার দায়িত্ব মতে ইউজিসি, মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি আমার নিয়োগকর্তা চ্যান্সেলরকে জানিয়েছি। এরপর সেখান থেকে একটি তদন্ত কমিটি হলে বোর্ড আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়। যদিও বোর্ডে কয়েকজন সৎ ব্যক্তি সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অনলাইনে সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশনে সরওয়ার জাহান সবসময় কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছাড়াই ক্লিয়ার দিয়ে দিতেন। আমি অভিযোগ পেলাম অনলাইনে কতগুলো ভুয়া সাইট তৈরি করে জাল সনদ দেওয়া হচ্ছে। এরপর আমি সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশনটাকে অফলাইন করে দিলাম। তারপর বোর্ডে অভিযোগ দেওয়া হলো, আমরা ভেরিফিকেশন করতে বিলম্ব করছি। আমরা বললাম কোনগুলো দেরি হচ্ছে দেখান। যেগুলো ফেইক বা জাল সেগুলো ভেরিফিকেশন করতে সময় লাগবে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার এবং ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্য সচিব সরওয়ার জাহানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
ভোরের আকাশ/ সু