চট্টগ্রাম ওয়াসায় বেড়েছে ‘বদি আলমের’ দৌরাত্ম্য। ওয়াসার ৪১ জন বৈধ মিটার রিডারের হয়ে নিয়মিত কাজ করেন তারা। একেকজন মিটার রিডারের অধীনে ১৫ থেকে ২০ জন করে ‘বদি আলম’ কাজ করে। এরা গ্রাহকদের বাসায় গিয়ে মিটার রিডিং নেন। আর মিটার রিডাররা সারাদিন অফিসে বসে সময় পার করে মনগড়া বিল তৈরি করে পাঠান সেই ‘বদি আলমদের’ দিয়ে। যা নিয়ে গ্রাহকদের দুর্ভোগ-হয়রানি লেগেই রয়েছে সারা বছর। অপচয়ের নামে পানি চুরির আয়ের একটি অংশ রিডাররা ব্যয় করেন ‘বদি আলম’ দের বেতন দিতে। একজন ‘বদি আলম’ কে বেতন দেওয়া হয় ২০ হাজার টাকা। অথচ একজন বৈধ মিটারের বেতন সর্বসাকুল্যে ৩০ হাজার টাকার মতো।
জানা যায়, চট্টগ্রাম ওয়াসার আয়ের উৎসব হলো পানির বিল। এছাড়া গভীর নলকূপের লাইসেন্স ফি ও এফডিআরের অর্থ। ওয়াসার পানির উৎপাদন বাড়লেও বাড়েনি আয়। উল্টো সিস্টেম লস দেখিয়ে প্রতিদিন ১০-১২ কোটি লিটার পানি চুরি হচ্ছে। আর এসব চুরির পেছনে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে ‘বদি আলমদের’ বিরুদ্ধে। এরপরও তাদের দৌরাত্ম্য কমানো যাচ্ছে না। কমছে না গ্রাহকদের ভোগান্তিও। তাদের বিষয়ে অদৃশ্য কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
ওয়াসা সূত্র জানায়, পানি চুরি বন্ধে বসানো হবে ডিজিটাল মিটার। বাড়ি বাড়ি গিয়ে যেখানে রিডিং নেয়ার প্রয়োজন হবে না। বর্তমানে ৭টি স্থানে চলছে এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম। তবে পরীক্ষামূলক কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ সেই প্রকল্পের কাজ। চট্টগ্রাম ওয়াসায় প্রতিদিন ৯ থেকে ১০ কোটি লিটার পানির অপচয় হয়। এতে প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ক্ষতি হয় প্রায় ৩ কোটি টাকারও বেশি। ওয়াসায় বর্তমানে অপচয় বা সিস্টেম লস দেখানো হচ্ছে ২৬ থেকে ২৭ শতাংশ। তবে এর সিংহভাগই হচ্ছে চুরি। এই চুরির সঙ্গে মিটার রিডার ও ‘বদি আলম’দের জড়িত থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এরপরও তাদের কারো বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে মাসের পর মাস বছরের পর বছর ওয়াসার আর্থিক দুরাবস্থা চলছে।
অভিযোগ আছে, মিটার রিডাররা প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিস রুমে বসে সময় পার করেন। আর তাদের কাজ করেন প্রায় ‘বদি আলমরা’। এই ‘বদি আলমরা’ মিটার নষ্টের অজুহাতে বাণিজ্য করে। মিটারে পানির বিল কারসাজি করে টাকার বিনিময়ে কমিয়ে দেয়। এসব কাজে ওয়াসা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ‘বদি আলম ও তাদের নিয়ন্ত্রণকারী মিটার পরিদর্শকদের অনেকে এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। অনেকেই ব্যবহার করছেন দামি দামি মোটরসাইকেল। এছাড়া অনেকে বাড়ি-গাড়িও করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়াসার মিটার পরিদর্শক ফরহাদুর রহমান (মাদারবাড়ি), গিয়াস উদ্দীন (চকবাজার), মো. হাসান (পূর্ব ষোলশহর), মো. নাছির-২ (হামজারবাগ), মীর মো. লোকমান (মোহরা বিসিক মহল্লা), ইমরান (চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ) মিসেস রাবেয়া (লালখানবাজার) ও মাইমুনা (চকবাজার) এম এ হাশেম(অলংকার,একে খান, সরাইপাড়া) প্রতিদিন নিয়মিত দায়িত্ব পালন না করে অফিসের বসেই সময় কাটান। তাদের কাজ করেন ‘বদিআলম’রা। এছাড়া মিটার রিডার নারীদের কাউকে দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় কেউ দেখেননি এবং চেনেন না বলে জানান এলাকার বাসিন্দারা। বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন বদিআলমরা। মিডার রিডাররা তাদের সঙ্গে গ্রাহকদের যোগাযোগ করতে বলেন।
জানা গেছে, মীর মো. লোকমানের হয়ে মোহরা এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন মো. নায়েম। রাবেয়ার হয়ে লাখখানবাজারে কাজ করেন হারুন। ইমরানের হয়ে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে কাজ করেন শিবু। আর জামালখান ও স্টেডিয়াম এলাকায় কাজ করেন ‘বদিআলম’আবদুল মান্নান। এই কাজ করে আবদুল মান্নান এখন একাধিক বাড়ির মালিক।
পরিচয় গোপন রেখে মিটার রিডার মিসেস রাবেয়ার (লালখানবাজার) মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বদিআলম হারুনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
ওয়াসা সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৩ কোটি লিটার। রাজস্ব আয় হতো ৩ কোটি টাকা। একই বছর শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প-১ চালু হলে উৎপাদনে যোগ হয় আরও ১৪ কোটি লিটার পানি। এ সময়ে কয়েক দফা পানির দামও বাড়ানো হয়। কিন্তু তারপরে বাড়েনি রাজস্ব আয়। একপর্যায়ে সব মিটার রিডারকে একযোগে বদলি করার পর মাসিক রাজস্ব আয়ের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৯ কোটি টাকায়। ২০১৮ সালে ওয়াসার পানির উৎপাদনে যোগ হয় আরও ৯ কোটি লিটার। সবমিলে এখন ৩৬ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হলেও সে অনুপাতে বাড়েনি রাজস্ব আয়। অবস্থা অনেকটা ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলার মতো।
মিটার রিডার মীর মো. লোকমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নম্বর সঠিক নয় বলে জানান।
এরপর মীর মো. লোকমানের হয়ে কাজ করে বদিআলম নায়েমের মুঠোফোনে কল কেউ ধরেননি।
জামালখান-স্টেডিয়াম এলাকায় কাজ করা বদিআলম আবদুল মান্নান ওয়াসার ঠিকাদার হিসেবে কাজ করে বলে জানান।
এসব বিষয়ে জানতে ওয়াসার চিফ রেভিনিউ অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) প্রকৌশলী রানা চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে আমরা প্রায়ই শুনি। কিন্তু তাদের ধরা যায় না। অভিযানে গেলে তারা আগেভাগে খবর পেয়ে সটকে পড়ে। তবে আমরা চেষ্টা করছি এই সিস্টেম লসটা কমিয়ে আনার।
তিনি বলেন, একসময় সিস্টেম লস ৩১ শতাংশের উপরে ছিল। সেটা আমরা কমিয়ে এনে ২৬ শতাংশে এনেছি। সামনে আরও কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। পানি চুরি রোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে।
ভোরের আকাশ/ সু