১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবেগৌড়ার সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে। চুক্তি নবায়নের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছিলো, ফারাক্কা নিয়ে তত বেশি সরব হতে দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে। কারণ, আগেরবার চুক্তির সময় ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন এইচ ডি দেবেগৌড়ার সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতিবসুকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তির নবীকরণ হলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সরকারের যে চুক্তি হবে তাতে সঙ্গে থাকতে হবে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা থেকে বাদ পড়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার ক্ষোভের কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে এমন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তার সরকারের মতামত বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মমতার নাখোশ হওয়ার অন্যতম কারণ গঙ্গা চুক্তি নবায়ন। দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এই চুক্তিটির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হবে। তবে শেখ হাসিনার সফরের সময় এই চুক্তি নবায়ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে দুই দেশই সবুজ সংকেত দিয়েছে। তবে এই চুক্তি নবয়ান নিয়ে আলোচনায় রাজ্য সরকারের মতামত বিবেচনায় নেয়া হয়নি বলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মমতা।
তবে আনন্দবাজারের খবরে বলা হয়েছে, গত শনিবারই (২২ জুন) ফরাক্কা চুক্তির নবায়ন হয়ে গেছে। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করেছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল। তাদের মূল অভিযোগ, রাজ্য সরকারকে এড়িয়ে এই চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। তৃণমূলের তরফে এই চুক্তি নবায়নকে বাংলাকে ‘বিক্রি করার পরিকল্পনা’ হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের এই সংবাদমাধ্যমটি বলছে, তৃণমূলের বক্তব্য হলো ফরাক্কা-গঙ্গা চুক্তিতে রাজ্য সরকারও পক্ষ। তবে নবায়নের বিষয়ে রাজ্য সরকারকে কিছুই জানানো হয়নি, যা অত্যন্ত খারাপ।
১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি হয়। এই চুক্তিতে ভারতের একাধিক রাজ্য সরকারও শরিক। ২০২৬ সালে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে।
গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে কথা বলার সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টিও সামনে নিয়ে এসেছে মমতার তৃণমূল। খানিকটা হুঁশিয়ারির সুরে দলটি বলেছে, সংবিধান অনুযায়ী অন্য দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে পারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। তবে কেন্দ্রকে এটাও বুঝতে হবে, রাজ্য সরকার সহযোগিতা না করলে তিস্তার পানি বণ্টনের মতো চুক্তি থমকে থাকে। অনেকের মতে, পশ্চিমবঙ্গকে এড়িয়ে গঙ্গা চুক্তি নবায়ন করায় তিস্তা চুক্তি আরও পিছিয়ে গেল।
মমতা বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার যখন বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা চুক্তি করেছিল, আমরা তাদের জল দিয়েছিলাম। কেন্দ্রীয় সরকার তখন লিখিতভাবে চুক্তি করেছিল, পরিবর্তে আমাদের টাকা দেয়া হবে এবং সেটা আমাদের ফারাক্কাকে ভালো রাখবার জন্য। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা সেই ৭০০ কোটি টাকা পাইনি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ভালোবাসার কারণে বাংলাদেশকে পানি দিতে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নির্বাচনী প্রচার কালে বিভিন্ন সমাবেশে তিনি তবে এজন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বকেয়া অর্থ দাবি করেছেন তিনি।
বিশ্লেষকদের মতে, যখন তিস্তার পানিচুক্তি নিয়ে ঢাকা দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গের দিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছে। আবার দুই বছর পর বিদ্যমান ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গাচুক্তির কার্যকাল শেষ হবে। যেখানে নানা জটিলতায় তিস্তার পানি চুক্তি হচ্ছে না. সেখানে গঙ্গা চুক্তির নবীকরণে মমতা ব্যানার্জির এমন অবস্থান ঢাকা ও দিল্লির কূটনীতিকদের মাঝে নতুন চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে।
তাদের মতে, মমতা কী সত্যিই ঢাকাকে পানি দিতে চান, নাকি দিল্লির কাছ থেকে পাওনা টাকা তুলতে চান; তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে বিভিন্ন সময়ে মমতা বলেছেন বাংলাদেশকে পানি দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি হাসিনাজিকে ব্যক্তিগতভাবে ভালোবাসি। মমতা প্রশ্ন তোলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে গঙ্গা চুক্তি বাবদ রাজ্য সরকারের প্রাপ্য টাকা কেন্দ্রীয় সরকার এখনো দেয়নি কেন?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গার পানি চুক্তির সময় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কি বলেছিল বা সে নিয়ে মমতা ব্যানার্জি কি বলেছেন তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। এটা সম্পূর্ণই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা মনে করি, আমাদের ন্যায্যদাবি অনুযায়ী ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের পানি পাওয়া উচিত।
বাংলাদেশকে পানি বণ্টনের বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে মমতা বলেন, আমাদের জল বাংলাদেশকে দিলে, আমার তাতে আপত্তি নেই। হাসিনাজিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে ভালোবাসি। ঠিক আছে। কিন্তু তার পরিবর্তে কেন্দ্র আমাদের রাজ্য সরকারকে ৭০০ কোটি টাকা দেবে বলেছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত এক পয়সা আমরা পাইনি।
অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত বিষয়টি নিয়ে দৈনিক ভোরের আকাশের সাথে আলোচনা কালে বলেন, সবকিছুর আগে আমাদের ভাবতে হবে তিস্তা সমস্যা আমাদের এবং ভারতের উভয়ের। আমাদের সমস্যা বেশী ভারতের কম হলেও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে লাভবান হবে উভয় দেশ। এতদিন ভারতের সাথে নিকট আমাদের দাবী ছিলো তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে কিন্তু মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে চীন যখন অতি আগ্রহ দেখালো তখন ভারতের আগ্রহ বেড়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন আমাদের প্রয়োজন, আর এটি কোনো সাধারণ বিষয় নয়। যাকেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হোক না কেনো চেষ্টা করতে হবে অনুকুল শর্তে যেনো সেটা দেওয়া হয়।
গঙ্গা চুক্তি নবায়ন নিয়ে পশ্চিম বঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃনমুলের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ড. বারাকাত বলেন, এটি ভারতের আভ্যন্তরীন ব্যাপার তবে আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট হলো কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তির পক্ষে আছে। তবে যেহেতু তাদের (ভারতের) যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিতে রাজ্য সরকারের অন্তর্ভুক্তির বিষয় রয়েছে এবং আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আছে সকলের সঙ্গে সু সম্পর্ক রেখেই সব কিছু আদায় করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্য সরকারের সাথেও কুটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন চেষ্টা করা যেহেতু এটি আমাদের দরকার।
তিনি আরও বলেন, ভারতের টেকনিক্যাল কমিটি বাংলাদেশে আসছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে কিন্তু এ পরিকল্পনা নিয়ে চীনের আগ্রহ বেশী যদি আমরা উভয়কে একসাথে রেখে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে পারি তাহলে হয়তো বিষয়টি আরও সহজ হবে। কেননা তিস্তা মহা পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ভারত ছাড়াও ভু রাজনৈতিক অর্থনীতিতে চীনেরও স্বার্থ জড়িত।
ভোরের আকাশ/মি