logo
আপডেট : ৩০ জুন, ২০২৪ ১৮:০৬
বর্ষায় পাহাড় ধসের আতঙ্কে লক্ষাধিক মানুষ
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

বর্ষায় পাহাড় ধসের আতঙ্কে লক্ষাধিক মানুষ

ক্যাপশন : লাখাইছড়া চা-বাগানের উড়িষ্যা টিলায় ঝুঁকিতে চা-শ্রমিকদের বাড়িঘর

বন্যার সঙ্গে পাহাড়ধস নিয়ে সমান আতঙ্কে ভুগছেন মৌলভীবাজার জেলায় পাহাড় ও টিলায় বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। পাহাড় ও টিলাখেকোদের দৌরাত্ম্য যেমন বেড়েই চলছে, তেমনি ঝুঁকি নিয়ে টিলার পাদদেশে বসবাস করছেন সেখানকার বাসিন্দারা। পাহাড়ের চূড়ায় ও পাদদেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ জেলায় বসবাস করছেন কমপক্ষে লক্ষাধিক মানুষ।

 

বিশেষ করে জেলার শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা ও রাজনগর উপজেলায় পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে প্রকাশ্যে ও গোপনে পাহাড় ও টিলা কাটা চালিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল। প্রাচীনকালের অসংখ্য টিলা ও পাহাড় ইতোমধ্যে এলোপাতাড়ি কাটা হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত থাকলেও থামানো যাচ্ছে না টিলা কাটা। এতে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছেন পরিবেশবিদরা।

 

টিলাভূমি টুকরো-টুকরো করে কেটে চুরমার ও দখল করে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা। যার ফলে প্রতিবছর বর্ষাকালে ভয়াবহ ধস নামছে টিলাগুলোতে। আবাসন, অস্থায়ী নিবাস, রিসোর্ট, হোটেল, মুরগির খামার, উঁচু দালান নির্মাণের লক্ষ্যে অবাধে প্রাকৃতিক পাহাড় ও টিলাগুলোতে কোদাল-খুন্তির আগ্রাসন নিয়মিত চললেও প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

 

পাহাড় ও টিলা কাটায় ধস নেমে একদিকে প্রতিবছর বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা অন্যদিকে বন্যপ্রাণীরা আবাসস্থল হারিয়ে প্রতিনিয়তই চলে আসছে লোকালয়ে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে মৌলভীবাজারের পাহাড়ি জনপদের বাসিন্দাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। অবিরাম ভারী বর্ষণে পাহাড়ধসে বাড়ছেই মৃত্যুর মিছিল। এরপরও পাহাড়ের চূড়ায় ও পাদদেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লক্ষাধিক মানুষ। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ টিলার ওপরে ও পাদদেশের বাসিন্দাদের সরে যেতে অনুরোধ জানানো হলেও তাদের পুনর্বাসনের কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। যারা ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন তাদের দাবি, বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা না থাকায় মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিয়েই পরিবার-পরিজনসহ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছেন তারা।

 

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় টিলাধসে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। বেসরকারি এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গত দুই দশকে মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে টিলাধসে মারা গেছেন নারী-শিশুসহ প্রায় শতাধিক মানুষ। এ ছাড়া প্রাণ গেছে দুই শতাধিক গবাদিপশুর। শুধু ২০২২ সালের বর্ষা মৌসুমে জেলার শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ ও বড়লেখা উপজেলায় টিলাধসে মাটিচাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন নারী-শিশুসহ ৯ জন। আহত হয়েছেন ৬ জন। গবাদিপশু মারা গেছে ১০টি।

 

জানা গেছে, ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বিকালে জেলার কুলাউড়া উপজেলায় প্রবল বর্ষণে টিলার মাটি ধসে পড়ে মারা গেছেন চাতলাপুর চা-বাগানের ৬ নম্বর বাউরি টিলার কড়ইতল এলাকার চুনু বাউরির স্ত্রী শেফালি বাউরি (৪৮)। ওই বছরের ২৬ মার্চ কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের ইসলামনগর গ্রামে টিলাধসে মাটিচাপা পড়ে মারা যান ভাটেরা ইউনিয়নের পশ্চিম ইসলামনগরের সুমন মিয়া (১৫), নাহিদ আহমদ (১৪) ও আব্দুল কবির (৯) নামের তিন শিশু-কিশোর।

 

একই বছরের ১৬ থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত ভারী বর্ষণে বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলায় প্রায় ২ শতাধিক টিলাধসে পড়ে। ১৮ জুন বড়লেখা উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নে আয়েশাবাদ চা-বাগানের শ্রমিক অর্জুন বোনার্জী (৬৫) টিলাধসে মাটিচাপা পড়ে মারা যান। একই দিনে বড়লেখার কেছরিগুল ও বিওসি ছেরিগুল গ্রামে পৃথক টিলাধসে আরও ৫ ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। আহতরা হলেন সালমা বেগম, নিহা বেগম, রহিমা বেগম, সামছু মিয়া ও জোনাকি আক্তার। ওই দিনেই জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নে টিলা ধসে মাটিচাপা পড়ে মারা যায় ১০টি গবাদিপশু।

 

এ ছাড়া ১৯ আগস্ট সকালে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সীমান্তবর্তী ফিনলে টি কোম্পানির লাখাইছড়া চা-বাগানের উরিষ্যা টিলাধসে মারা যান হীরা রানি ভূমিজ (৩০), পূর্ণিমা ভূমিজ (২৫), রাধা মাহালী (৪৫) ও রীনা ভূমিজ (২০) নামের চার নারী চা-শ্রমিক। এ ঘটনায় আহত হন কিশোরী অঞ্জনা ভূমিজ।

 

চলতি বছরের ৩১ মে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর বনবিটের অধীন কালেঞ্জি খাসিয়া পুঞ্জি এলাকায় টিলাধসে গীতা কাহার (৩০) নামে এক নারী চা-শ্রমিকের মৃত্যু হয়।

 

অনুসন্ধান ও সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাধানগর, মোহাজেরাবাদ, বিষামণি ও জাম্বুরাছড়া; বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলী, মাধবকুণ্ড, কাশেমনগর, জামকান্দি, বিওসি কেছরিগুল, মোহাম্মদ নগর, পূর্ব মোহাম্মদ নগর, ডিমাই, দক্ষিণ ডিমাই, উত্তর ডিমাই, হাতি ডিমাই, উত্তর শাহবাজপুর, শ্রীধরপুর, বোবারথল, সাইপুর, পূর্ব হাতলিয়া, কলাজুরা, হাকাইতি, সাতরাকান্দি, গঙ্গারজল, জাফরপুর, কাশেমনগর, কুমারশাইল, গজভাগ, ছোটলেখা, ঘোলসা, চন্ডিনগর, মুড়াউল, আতুয়া, বড়াইল, পূর্ব বানীকোনা ও খলাগাঁও; জুড়ী উপজেলার ভজি টিলা, চম্বকলতা, উত্তর ভবানীপুর (মোকাম টিলা), বড় ধামাই, কচুরগুল, জামকান্দি, গোবিন্দপুর, জায়ফর নগর, গোয়াল বাড়ি, পশ্চিম জুড়ী ও পূর্ব জুড়ী; রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ, যুদুরগুলসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ইতোমধ্যে উঁচু-নিচু পাহাড় কেটে প্রায় সমতলের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর অর্ধেক টিলা কেটে বাড়িঘর করা হয়েছে অসংখ্য। আর ওই বাড়িঘরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েক হাজার পরিবার।

 

এদিকে, টিলা কাটার অভিযোগে চলতি বছরের ২৮ মে মৌলভীবাজারের জুড়ীতে রাস্তা সংস্কারের নামে অবৈধভাবে চা-বাগানের টিলা কাটার দায়ে প্রদীপ যাদব নামের ইউপি এক সদস্যকে মোট ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। প্রদীপ যাদব উপজেলার সাগরনাল ইউপির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য।

 

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট-এর সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আখতার বলেন, ‘২০১২ সালে বেলার পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে একটি রিট (পিটিশন নং-৯৭৫০/১১) আবেদন করা হয়। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১ মার্চ আদালত সিলেটে পাহাড়-টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একই সঙ্গে পাহাড়-টিলা সংরক্ষণ ও এর পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ দরিদ্র মানুষজনকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু রায়ের ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘কী পরিমাণ লোক ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করেন তারও কোনও হিসাব নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। তাদের পুনর্বাসন বা টিলা সংরক্ষণে সরকারি কোনও উদ্যোগ বা প্রকল্প নেই। বরং টিলা ধ্বংস করে অনেক প্রকল্প আছে।’

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) জাতীয় পরিষদ সদস্য আ স ম সালেহ সোহেল বলেন, ‘মৌলভীবাজার জেলায় অবাধে টিলা কাটার ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশগত অবস্থা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অবাধে টিলা ও পাহাড়ের মাটি কাটার ফলে ভূমির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে ভূমিধসে প্রতিবছর মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। অনেকে টিলার মধ্যে বাড়িঘর বানাচ্ছেন, টিলা কেটে রাস্তা বানাচ্ছেন। পাহাড়-টিলা কাটা ও টিলার পাদদেশে স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ আইনিভাবে অবৈধ। কিন্তু সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় অবৈধভাবে স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। এ কারণে পাহাড়ধসে প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। যে অবস্থা চলছে এতে আগামীতে হয়তো টিলা বলতে কোনও কিছু থাকবে না। বাপার পক্ষ থেকে পরিবেশ সংরক্ষণ ও নদী সংরক্ষণের বিষয়ে প্রতিনিয়তই সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছি। রাষ্ট্রীয় আইন আছে, কিন্তু আইনের কোনও প্রয়োগ নেই। রাষ্ট্র উদ্যোগী ভূমিকা না নিলে কিছুই করা সম্ভব না। আমরা চাই টিলার পাদদেশে যাতে কোনও বাড়িঘর না থাকে সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মৌলভীবাজারের জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার অবস্থা একেবারে শোচনীয়।’ এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, না হলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

 

পরিবেশ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের সহকারী পরিচালক মো. মাঈদুল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড় ও টিলা কাটার দায়ে এ পর্যন্ত ২২টি মামলা করেছি। আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। অনেকসময় বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়ে অভিযান পরিচালনা করে থাকি। এখন থেকে যদি পাহাড় কাটা থামানো না যায় তাহলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে। যার কারণে বর্ষা মৌসুমে টিলাধসের আশঙ্কা বেশি থাকে।’

 

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে এবং প্রত্যেক ইউএনওদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। মাইকিং করে সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের সরে যেতে বলা হচ্ছে। বর্ষাকাল চলছে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসতে আমরা কাজ করছি।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘টিলা কাটার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয়দের পুনর্বাসনের বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হবে।’

 

ভোরের আকাশ/মি