পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটির পর ৩ জুলাই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুলেছে। দীর্ঘদিন পর শিশুরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফিরলেও পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার পিঁপড়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র ভিন্ন। শিক্ষকেরা যথাসময়ে বিদ্যালয়ে এলেও শিক্ষার্থী উপস্থিতি নেই বললেই চলে। নদীভাঙনের আশঙ্কায় অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন না।
ওই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়ার বাড়ি পিঁপড়াখালী গ্রামে। বুধবার বিদ্যালয়ে পাঠাননি তার মা রুনু বেগম। সাদিয়া বিদ্যালয়ের আশপাশে ঘুরছিল। সাদিয়া বলেন, ‘এত দিন পর বিদ্যালয় খুলল। কিন্তু যেতে পারলাম না। এ জন্য মন খারাপ।’
তার মা রুনু বেগমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জীবনের চেয়ে তো আর লেখাপড়া বড় নয়। যেকোনো সময় নদীতে ভেঙে যেতে পারে বিদ্যালয়টি। কীভাবে ওকে বিদ্যালয়ে পাঠাই?’ সরেজমিনে দেখা যায়, পায়রা নদী তীরবর্তী পিঁপড়াখালী গ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ ঘেঁষে বিদ্যালয়টির অবস্থান। পায়রার ভাঙনে বেড়িবাঁধের অর্ধেকের বেশি ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পায়রা নদী ভাঙতে ভাঙতে বিদ্যালয়টির একেবারে কিনারে এসে ঠেকেছে। বিদ্যালয়ের মেঝেতে ফাটল দেখা দিয়েছে। যেকোনো সময় নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে বিদ্যালয়টি। আতঙ্কের মধ্যে ক্লাস করতে হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের।
কথা বলে জানা যায়, বিদ্যালয়টিতে শিক্ষকের পদ রয়েছে সাতটি। বর্তমানে কর্মরত আছেন তিনজন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতে কমতে বর্তমানে ৩৮ জন হয়েছে। তারাও সবাই ভয়ে বিদ্যালয়ে আসছে না। বুধবার সাত থেকে আটজন উপস্থিত ছিল। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নুহা বলে, ‘আমাদের ক্লাসে আসতে খুব ভয় লাগে। আমাদের অনেক বন্ধু অন্য বিদ্যালয় চলে গেছে। আমাদের কাছাকাছি কোনো বিদ্যালয় না থাকায় বাধ্য হয়ে এখানে পড়তে আসি।’
সহকারী শিক্ষক শামীমা নাসরিন বলেন, ভাঙতে ভাঙতে নদী বিদ্যালয়ের খুব কাছে চলে এসেছে। ভয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসে না। তাঁদেরও ভয় লাগে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯২৬ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে জাতীয়করণ হয় বিদ্যালয়টি। পায়রা নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে কয়েকবার বিলীন হয়েছে বিদ্যালয়ের ভবন। ২০১৭ সালে বিদ্যালয় ভবনটি নদীভাঙনের কবলে পড়লে পাকা দ্বিতল ভবনটি নিলামে বিক্রি করে পাশের জমিতে একটি টিনশেড ভবন করা হয়। বছর যেতে না যেতেই ২০১৮ সালে আবার বিদ্যালয়টি ভাঙনের কবলে পড়লে সরিয়ে নেওয়া হয় অন্য জমিতে। নদীভাঙনের তীব্রতা অব্যাহত থাকায় আবারও ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে বিদ্যালয়টি।
২০১৮ সালের অক্টোবরে মো. ইউসুফ আলী হাওলাদার ও মো. সাহাবুদ্দিন খান গং পৃথক স্থানে যথাক্রমে ৫০ ও ৬০ শতাংশ জমি বিদ্যালয়ের নামে দান করেন। দুই পক্ষই চায়, তাদের দেওয়া জমিতে বিদ্যালয়টি স্থানান্তর হোক। এ অবস্থায় ভাঙন এলাকা থেকে বিদ্যালয়টি আজও সরেনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জমিদাতা সদস্যরা বারবার বৈঠক করেও একমত হতে পারেননি।
শিক্ষকেরা বলেন, দুই পক্ষের এ দ্বন্দ্বের কারণে বিদ্যালয়েরও ক্ষতি হয়েছে। ২০১৯ সালে ৫ কক্ষবিশিষ্ট একটি সেমিপাকা ভবন নির্মাণের জন্য ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। স্থান নির্ধারণ নিয়ে দুই পক্ষ একমত না হতে পারায় সরকারি বরাদ্দের সেই টাকা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সরকারি কোষাগারে ফেরত যায়।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুজিত মজুমদার বলেন, শিশুদের নিয়ে সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকতে হয়। ভবনটি নদীগর্ভে চলে যেতে পারে যেকোনো সময়। এতে খোয়া যেতে পারে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। বিদ্যালয়ের ভবনটি অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য ইউএনও কাছে তিনি লিখিত আবেদন করেছেন। ইউএনও পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। মঙ্গলবার ওই কমিটি বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছে।
ইউপি চেয়ারম্যান ও কমিটির সদস্য আবুল বাশার নাসির বলেন, বিদ্যালয়টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এটি অন্যত্র স্থানান্তর জরুরি। এ বিষয়ে জমিদাতা মো. সাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘জমি দিয়েছিলেন আমার বাবা মৃত আবদুল লতিফ খান। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর দান করা জমিতে বিদ্যালয়ের ভবনটি নির্মিত হোক। তবে এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমি তাতে একমত।’
অন্য জমিদাতা মো. ইউসুফ আলী বলেন, ‘আমরা উভয় পক্ষ কয়েক দিন আগে একটি বৈঠকে বসেছিলাম। আশা করি, বিদ্যালয়টি রক্ষার্থে খুব শিগগির একটি সমাধানে পৌঁছাতে পারব।’ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রিয়াজুল হক বলেন, পায়রার ভাঙনের হাত থেকে বিদ্যালয়টি রক্ষার্থে সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভোরের আকাশ/মি