logo
আপডেট : ২৮ জুলাই, ২০২৪ ১১:৪৫
দেশে অবৈধ নৌযান ৮৩ হাজার
আশীষ কুমার দে

দেশে অবৈধ নৌযান ৮৩ হাজার

  • বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি
  • রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
  • কোনো সংস্থার কাছেই তথ্য নেই


দেশের নদ-নদী ও সাগরে চলাচলকারী নৌযানের সঠিক পরিসংখ্যান নেই কোনো সংস্থার কাছে। তবে এক লাখেরও বেশি নৌযান চলাচল করে বলে সরকারি একটি সূত্র জানিয়েছে। এগুলোর মধ্যে বৈধ নৌযান মাত্র ১৭ হাজার। বাকি ৮৩ হাজার নৌযানই অবৈধ। এগুলোর চালকও দক্ষ নন। অনেকের নেই লাইসেন্স। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এছাড়া নিবন্ধনের আওতায় না আনার কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডারসহ নদী ও নৌপরিবহন খাত নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও উপকূলীয় নৌপথে হাজার হাজার অবৈধ নৌযান চলাচল করলেও সেগুলোর ওপর সরকারের জোর তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ নেই। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ শুধু নিবন্ধিত নৌযান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর এ কারণে প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও ছোট-বড় নৌদুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া সরকার প্রতি বছর মোটা অংকের টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।

অন্যদিকে, বিপুল পরিমাণ অবৈধ নৌযান চলাচলের সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ নৌপথ তদারককারী সংস্থাগুলোর কিছুসংখ্যক সদস্য এসব নৌযান মালিকের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করছে।

নৌ-খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১০ বছরে দেশে নতুন নৌযান নিবন্ধিত হয়েছে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি। ২০২৩ সালের ২২ জুন পর্যন্ত নিবন্ধিত অভ্যন্তরীণ নৌযানের মোট সংখ্যা ১৬ হাজার ৯৮০। এই সংখ্যা ২০১৩ সালে ছিল ৯ হাজার ৩৬৭। এই হিসেবে ১০ বছরে নৌযান বেড়েছে ৭ হাজার ৬১৩টি। যদিও এ সময়ে নতুন নৌযান বৃদ্ধির প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি। তবে প্রতি বছর সংখ্যায় বাড়লেও সব নৌযান নিবন্ধনের আওতায় আসছে না।

বৈধ নৌযান কত : নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে নিবন্ধিত অভ্যন্তরীণ নৌযানের মধ্যে যাত্রীবাহী লঞ্চ ৮৫৭টি, যাত্রীবাহী বোট-ট্রলার ৫৪৯টি, মালবাহী ৩ হাজার ৭৪৪টি, তেলবাহী ৩৯০টি, বালুবাহী ৬ হাজার ৩৭৯টি। ড্রেজার ১ হাজার ৭৯৬টি, পণ্যবাহী নৌযান (লাইটার জাহাজ) ১ হাজার ২১২টি, বার্জ ৫৪৪টি, টাগবোট ১৭৯টি, স্পিডবোট ১,০০৩টি, ফেরি ৪৬টি, ওয়ার্কবোট ১৩৭টি, পরিদর্শন বোট ২৬টি, ট্যুরিস্ট লঞ্চ ১০টি ও অন্যান্য ১০৮টি।

অবৈধ নৌযান কত : ‘অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও) ১৯৭৬’-এর অধীনে প্রণীত বিধি এবং এ সংক্রান্ত দপ্তর আদেশে বলা হয়েছে, সর্বনিম্ন ১৬ হর্স পাওয়ার (অশ্বশক্তি) ক্ষমতাসম্পন্ন অথবা ১২ জনের অধিক যাত্রী ধারণক্ষমতার ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচলের জন্য নকশা অনুমোদন, নিবন্ধন ও সার্ভে (ফিটনেস) বাধ্যতামূলক। দেশে নিবন্ধিত নৌযানের বাইরে অনিবন্ধিত কতো নৌযান আছে তার কোনো পরিসংখ্যান বিআইডব্লিউটিএ ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কাছে নেই। দেশে কতো সংখ্যক নৌযান চলাচল করছে তার পরিসংখ্যান তৈরি করতে ২০১৬ সালে নৌশুমারির উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। তবে প্রকল্পটি শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে এই সংখ্যা এক লাখের অনেক বেশি।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কমডোর (অব.) এম যোবায়ের আহমেদ বলেন, রেজিস্ট্রেশন ও সার্ভে (নিবন্ধন ও ফিটনেস) সনদধারী নৌযানের সংখ্যা যাই হোক না কেনো, বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে দেশে প্রায় দুই লাখ নৌযান চলাচল করে।

অধিদপ্তরের আরেক সাবেক মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) বজলুর রহমান এক চিঠিতে নৌসচিবকে জানিয়েছিলেন, অভ্যন্তরীণ সেক্টরে ৩৫ হাজারেরও বেশি নৌযান রয়েছে। একই সংস্থার আরেকজন মহাপরিচালক কমডোর মো. নিজামুল হক গত বছর নৌ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে জানিয়েছেন, দেশে ৮৫ হাজার নৌযান চলাচল করে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক তিন মহাপরিচালকের আলাদা আলাদা তথ্য পর্যালোচনা ও গড় হিসাব করলে অভ্যন্তরীণ নৌযানের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৬ হাজার।

বিপুলসংখ্যক অবৈধ নৌযান চলাচলের ফলে সরকার যেমন একদিকে রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে নৌপথে অপরাধও বাড়ছে। নৌযাত্রী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে।

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজি মোহাম্মদ শহীদ মিয়া বলেন, ২০১৬ সালে নৌশুমারির একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেটার অগ্রগতি হয়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকদের বক্তব্য থেকে জানা গেছে, মোট নৌযানের সংখ্যা লক্ষাধিক; যার মধ্যে ৮০ হাজারেরও বেশি অবৈধ।

হাজি শহীদ মিয়া বলেন, প্রথমত সরকার নৌপথে নাব্য ঠিক রাখতে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করছে। কিন্তু অবৈধ যানগুলো থেকে কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, অবৈধ নৌযান দুর্ঘটনার শিকার হলে নথিভুক্ত করা হয় না। এসব যানে যারা মাস্টার-ড্রাইভার থাকেন তাদেরও সনদ থাকে না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তারাও চেষ্টা করেন বিষয়টা গোপন করতে।

তিনি আরো বলেন, আমার মনে হয় কর্তৃপক্ষ এটিতে মনোযোগী না। এসব নৌযান আইনের আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে ছাড় দিতে হবে। যাতে অবৈধ এসব যান নিবন্ধনে মালিকদের আগ্রহ তৈরি হয়। সরকার শিথিল হলে, সচেতনতা বাড়ানো হলে, নৌযান নিবন্ধন বাড়বে, এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম বলেন, বৈধ-অবৈধ সব নৌযানেই চাঁদাবাজি হয়। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি একটি দুষ্টচক্রের সঙ্গে জড়িত। তবে অবৈধ নৌযানে চাঁদাবাজি বেশি হয়। এর বাইরে অবৈধ নৌযান থেকে প্রশাসনও সুবিধা নিয়ে থাকে।

লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আলহাজ বদিউজ্জামান বাদল বলেন, নিবন্ধিত ও ফিটনেসপ্রাপ্ত নৌযানের বাইরে কতোগুলো অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন নৌযান রয়েছে, সে তথ্য সরকারি দপ্তরগুলোতে নেই। তবে মালিকরা এ বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন। ফলে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মীর তারেক আলী বলেন, অনিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা কত, তা বলা কষ্টকর। ১৯৭৬ সালে জারি করা অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশটি (আইএসও) ২০০১ সালে আপডেট করা হয়। এরপর ২০ বছর এটিতে আর হাত দেওয়া হয়নি। তবে নৌযানের সংখ্যা প্রতি বছর যতই বাড়ুক, সেগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে না পারলে সরকার রাজস্ব হারাবে। এছাড়া এসব নৌযান নিয়ন্ত্রণ করাও কষ্টকর। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।

ভোরের আকাশ/ সু