logo
আপডেট : ২৯ জুলাই, ২০২৪ ১২:০৮
সরেজমিন পঙ্গু হাসপাতাল
যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন রোগীরা,অঙ্গহানির শঙ্কায় অনেকে
শিপংকর শীল

যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন রোগীরা,অঙ্গহানির শঙ্কায় অনেকে

রাকিব মাহামুদ। বয়স আনুমানিক ২০ বছর। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। কোমরের নিচের অংশ কাঁথা দিয়ে ঢাকা। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছিল। কাছে গিয়ে ‘গুলিতে আহত কি না’ প্রশ্ন করতেই কেঁদে ওঠেন এই তরুণ। গা থেকে কাঁথা সরিয়ে দিতে বলেন। আর তখন দেখা গেল তার বাম পায়ের অর্ধেকটা নেই। কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত ব্যান্ডেজে মোড়ানো। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসা চলছে রাকিবের। চিকিৎসার স্বার্থে তার একটা পা কেটে ফেলা হয়েছে।

রাকিব বলেন, তিনি চিটাগাং রোড এলাকার একটা দোকানে কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো শুক্রবারও (১৯ জুলাই) দোকানে গিয়েছিলেন তিনি। বিকেলে চিটাগাং রোড এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া চলছিল। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাসায় ফেরার জন্য বের হন।

রাকিব বলেন, ‘রাস্তায় বের হলে আবার গোলাগুলি শুরু হয়, অন্য মানুষের দেখাদেখি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আমিও দৌড় শুরু করি। তখন একটা গুলি এসে আমার বাম পায়ে লাগে। আমার শরীরে একাধিক অপারেশন হয়েছে, বড় একটা অপারেশনের মাধ্যমে গত সোমবার বাম পায়ের হাঁটুর নীচের অংশ কেটে ফেলা হয়েছে।’

শুধু রাকিব নন; পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-২ ওয়ার্ডে এ রকম আরও ৫৬ রোগী আছেন। তাদের ছয়জনের পা কেটে ফেলতে হয়েছে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় পা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন আরও অনেকে। হাতে গুলি লেগেও কেউ কেউ গুরুতর আহত হয়েছেন, ছয়জনের হাত কেটে ফেলতে হতে পারে। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন হাত-পা যাতে কেটে ফেলতে না হয় সে জন্য। তবুও অনেকের শেষ রক্ষা হবে কি না নিশ্চিত নন চিকিৎসকরা। পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের কারও লেগেছে একটি গুলি, কারও একাধিক; আবার কেউ কেউ শরীরে ছররা গুলি নিয়েও বিছানায় কাতরাচ্ছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে তারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

চিকিৎসাধীন রোগীদের বেশিরভাগের দাবি, তারা বিক্ষোভ কিংবা সংঘর্ষে অংশ নেননি, জরুরি কাজে কিংবা জীবিকার তাগিদে বাসা থেকে বের হয়ে সংঘর্ষের মাঝে পড়ে কিংবা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার মুহূর্তে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

হাসপাতালের তথ্যকেন্দ্র থেকে জানা যায়, ১৭ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ৮০০ জন সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। ২৩১ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট সংঘর্ষে আহত হয়ে কোন ওয়ার্ডে কতজন চিকিৎসা নিয়েছেন, সে তথ্য আলাদাভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি বলে সেখানকার কর্মকর্তারা জানান।

আলাপ হয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিগত গাড়িচালক মাসুদের সঙ্গে। তিনিও ১৯ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হন। তার হাতটি কেটে ফেলতে হবে কি না চিকিৎসকরা এখনো তা নিশ্চিত নন।

মাসুদ বলেন, ‘ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম, তখন বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তুমুল সংঘর্ষ চলছিল। পুলিশের একটি গুলি এসে আমার হাতে লাগে। পুলিশের গুলিতে আমিসহ অনেকেই আহত হই; গুলিতে একটা কুকুরও মারা গেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমার হাতে একটা গুলি লেগে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। হাত কেটে ফেলতে হয় কি না, সে চিন্তায় দিন কাটছে।’

পাশে বসে অসহায় দৃষ্টিতে মাসুদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন স্ত্রী শেফালী বেগম। তিনি বলেন, ‘তিনজনের সংসারে স্বামীই একমাত্র উপার্জনকারী। মানুষটি গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে। ডাক্তাররা বলছেন, হাত যদি কেটে না-ও ফেলা হয়, আগামী দেড়-দুই বছর কোনো কাজ করতে পারবেন না তিনি। দিশেহারা শেফালীর প্রশ্ন কাজ না করলে আমাদের মুখে খাবার দেবে কে? এখন আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু গ্রামে গেলেও কে আমাদের খাওয়াবে। আমাদের রাস্তায় বসা ছাড়া উপায় নেই।’

পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে ১৭ বছরবয়সী কারখানা শ্রমিক মারুফ। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকার একটি এমব্রয়ডারি কারখানায় কাজ করে রিকশাচালক বাবাকে পরিবার চালাতে সহযোগিতা করে মারুফ। পঙ্গু হাসপাতালে বসে সেদিনের বর্ণনা দেন তিনি। মারুফ বলেন, ‘শনিবার (১৯ জুলাই) বিকেল ৫টার দিকে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলাম। চিটাগাং রোডে গোলাগুলি হচ্ছিল। চারদিকে মানুষ দৌড়াচ্ছিল। আমার বাম পায়ে একটা গুলি লাগে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

হাসপাতালের বিছানায় তার পাশে বসা ছিলেন মা মরিয়ম বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার ছোট বাচ্চাটাকে গুলি করা হলো, এ বয়সে তার একটা পা কেটে ফেলা হয়েছে। তার জীবন কীভাবে চলবে, এ কথা আমি কাকে বলবো?’

মারুফকে আরও এক মাসের বেশি হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। তাকে প্রথমে নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে ব্যান্ডেজ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে হৃদরোগ হাসপাতাল হয়ে পঙ্গুতে এখন তার চিকিৎসা চলছে।

পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের ৩০ জনের অবস্থা বেশি খারাপ। তাদের একাধিক অপারেশন লাগবে। ইতোমধ্যে অনেকের পা কেটে ফেলা হয়েছে। একেকজন রোগীর ৪-৮টি অপারেশন করতে হচ্ছে। স্বল্প সময়ে এতো অপারেশনের সুবিধা হাসপাতালে নেই।

একাধিক রোগীর অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের সিরিয়াল পেতে দিন পার হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসক ও নার্সদের কাছে বারবার ধর্ণা দিয়েও সুযোগ মিলছে না। এতে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।

শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকেলে রায়েরবাগ এলাকায় গুলি লাগে ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী রফিকের। তার ভাই নাদিম জানান, ‘ইতোমধ্যে ২টা অপারেশন করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) চিকিৎসকরা বলেছিলেন আরও ৩-৪টা অপারেশন লাগবে। এরপর আমরা আর সিরিয়াল পাচ্ছি না।’

দ্বায়িত্বরত ডাক্তাররা বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন ২০-২১টা রুটিন অপারেশন করা হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে ৪০-৫০টা অপারেশন করা সম্ভব হয়। এক সপ্তাহ ধরে অপারেশনের চাপ অনেক বেড়েছে। যে রোগীদের অবস্থা বেশি খারাপ, তাদের আগে অপারেশনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। শুধু যে আন্দোলনে আহত রোগীদের অপারেশন প্রয়োজন তা নয়, এর বাইরেও অনেক রোগীর অপারেশন প্রয়োজন। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি পরিস্থিতি সামাল দিতে।’

পঙ্গু হাসপাতালের ইয়েলো-১ ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই হাসপাতালে এখন পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু হয়েছে। একজনের মৃত্যু হাসপাতালে আনার আগেই হয়েছিল। আর একজনের দুটি পা-ই গুলিবিদ্ধ ছিল। তাকে এখানকার আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায়নি।

তিনি বলেন, এখানে ২৭২ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দুইজন রোগী মারা গেছেন। এখন ৭৫ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। বাকিরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এর মধ্যে পা কেটে ফেলতে হয়েছে ৬ জনের। হাতও কাটতে হয়েছে কয়েকজনের।’

হাত-পা কেন কেটে ফেলতে হচ্ছেÑ জানতে চাইলে ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বেশিরভাগই বুলেট ইনজুরি। বুলেটের কারণে রক্তনালী ছিঁড়ে গেছে। আর যেখান থেকে এটা ছিঁড়েছে, তার নীচে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে হাড় ও মাংসে পচন ধরে। কিডনি বিকল হয়ে যায়। তাই জীবন বাঁচাতে গুলিবিদ্ধদের হাত-পা কাটতে হচ্ছে।’

গুলিতে আহতদের মধ্যে আরও কতজনের এমন পরিণতি হতে পারে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেককে দেখা হচ্ছে। যারা হাসপাতালে রয়েছেন, তাদের প্রতিদিন ফলোআপ করা হচ্ছে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর শরীরের অবস্থা দেখার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, ‘হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বেশিরভাগ গুলিবিদ্ধ রোগীর জরুরি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তবে আরও রোগীর অস্ত্রোপচার করা লাগবে।’

ভোরের আকাশ/ সু