logo
আপডেট : ৩০ জুলাই, ২০২৪ ১১:৫৭
কোটা সংস্কার আন্দোলন
দৃষ্টিশক্তি হারানোর আশঙ্কায় অনেকেই
হেলাল সাজওয়াল

দৃষ্টিশক্তি হারানোর আশঙ্কায় অনেকেই

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় কাঁদানে গ্যাস, ইট-পাটকেল ও ছররা গুলিতে চোখে আঘাত পেয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪২৫ জন। এর মধ্যে চোখের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে ২৮৭ জনের। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের তথ্য দিতে রাজি হয়নি। চিকিৎসা গ্রহণকারীদের বেশির ভাগের চোখে ছররা গুলির আঘাত রয়েছে। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও চিকিৎসাধীন আছেন অনেকে।

চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতা চলাকালে এ পর্যন্ত ওইসব রোগীরা সেখানে চিকিৎসা নিতে যান। এরমধ্যে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত ৩১৯ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১২ জন এখনো ভর্তি আছেন। বাকিরা চিকিৎসা নিয়ে ইতোমধ্যে হাসপাতাল ছেড়েছেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কারও কারও চোখে একাধিকবার অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে। তবে কেউই ঠিকভাবে চোখে দেখতে পারছেন না। চোখের আলো আদৌ ফিরবে কি না- এমন শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন অনেকেই।

চিকিৎসা গ্রহণকারী অনেকেই জানিয়েছেন, তারা চোখে ঝাপসা দেখছেন। আবার কেউ কেউ মোটেও দেখছেন না। অনেকের চোখ থেকে ছররা গুলিও বের করা যায়নি। এ নিয়ে তাদের স্বজনরাও ভাবনায় পড়েছেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, অনেকে অস্ত্রোপচারের পর ছাড়পত্র নিয়ে চলে গেছেন। প্রতি সপ্তাহে ফলোআপের জন্য আসবেন তারা।

হাসপাতালের চতুর্থ তলায় মেইল ওয়ার্ডের ১নং কক্ষের একটি বিছানায় শুয়ে ছিলেন আল মামুন রাব্বী। সাভার এলাকার কলেজ অব ফাইন্যান্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তাঁর চোখে কালো চশমা। চশমা সরাতেই স্ফষ্ট দেখা গেল চোখের ক্ষত; গাঢ় লাল হয়ে আছে। ১৮ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় সাভার বাজারের শিমুলতলা এলাকায় প্রাইভেট পড়ে সিআরপি হাসপাতাল এলাকায় নিজের বাসায় যাওয়ার পথে তার চোখে ছররা গুলি লাগে।

রাব্বী জানান, অপারেশন করেও গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। ডাক্তার বলেছেন, গুলি অনেক ভিতরে ঢুকে যাওয়ায় বের করা সম্ভব হয়নি।

হাসপাতালে রাব্বীর সঙ্গে আছেন তার মা রোকেয়া আক্তার। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে ছেলেকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় এনাম মেডিকেলে নেওয়া হয়েছিল। খবর পেয়ে আমরা সেখানে ছুটে যাই। ছেলের চোখে ছররা গুলি লেগেছিল। তাই এনাম মেডিকেল থেকে ছেলেকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে রেফার করে। কিন্তু গাড়ি না চলাতে ছেলেকে নিয়ে সেদিন আসতে পারিনি। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে ২২ জুলাই রিক্সায় করে সাভার থেকে এই হাসপাতালে আসি।’

রোকেয়া আক্তার বলেন, ছেলের চোখে অপারেশন হলেও এখনো দেখতে পারছে না। আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। আমি মানুষের বাসায় কাজ করি। ছেলেকে ছোট রেখে ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছে। সেই থেকে মানুষের বাসায় কাজ করে ছেলের লেখাপড়ার খরচ যোগাড় করছি। মডার্ন হারবালের বাগানবাড়ির কেয়ারটেকার হিসেবে সেখানেই থাকি। আমার একমাত্র অবলম্বন ছেলের এমন অবস্থা দেখে আমিও চোখে অন্ধকার দেখছি। রাব্বীর ৬টি পরীক্ষা হয়েছে। এখনো ৭টি পরীক্ষা বাকি। পরের পরীক্ষাগুলো দিতে না পারলে আমার এতোদিনের শ্রম বিফলে যাবে। আমার ছেলে চোখে আলো ফিরে পাবে কিনা- এটাই এখন বড় চিন্তা।

হাসপাতালের চতুর্থ তলায় ১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন বরিশাল সদরের নথুল্লাবাদ এলাকার বাসিন্দা রাকিব। একটি মৎস্য খামারের ব্যবস্থাপকের চাকরি করেন করেন। দৃষ্টিশক্তি হারানোর শঙ্কায় থাকা রাকিব বলেন, তার পৈতৃকবাড়ি বরিশাল শহরের নতুন বাজার এলাকায়। স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে নিয়ে কাশিপুর এলাকায় থাকেন। ১৭ জুলাই বিকালে নিজের বাসা কাশিপুর থেকে নতুন বাজার যাওয়ার পথে নথুল্লাবাদ এলাকায় চোখ এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছররা গুলি লাগে। প্রথমে পাশ্ববর্তী ওষুধের দোকানে নিয়ে গেলে তারা আমার পিঠের গুলি বের করে দেয়।

রাকিব ভোরের আকাশকে জানান, ওইদিনই বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলে সেখানকার ডাক্তাররা এখানে রেফার করেন। পরেরদিন সন্ধ্যায় এখানে ভর্তি করা হয় এবং ১৯ জুলাই চিকিৎসকরা চোখে অপারেশন করেন।

মাদারীপুর শহরে রূপচান্দা ব্রান্ডের ভোজ্যতেল ডেলিভারির কাজ করেন অনীক হাওলাদার। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ১৮ জুলাই বিকেলে কাজ শেষে বিসিক এলাকা থেকে জজকোর্টের সামনে গেলে তাঁর মাথায় ও চোখে ছররা গুলি লাগে। ১৯ তারিখে এখানে ভর্তি হয়েছেন। অপারেশন করা হলেও মাথা ও চোখের গুলি বের করা হয়নি। দুই চোখে কিছুই দেখছেন না তিনি।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তাফা ভোরের আকাশকে বলেন, চোখে বিভিন্ন ধরনের আঘাত নিয়ে যাঁরা এসেছিলেন, তাদের মধ্যে ইটপাটকেল ও কাঁদানে গ্যাসে আহত ছিলেন অনেকে। তবে বেশির ভাগই ছররা গুলিতে আহত। তাঁদের প্রাথমিক অপারেশন যেটা প্রয়োজন, সেটা করা হয়েছে। অনেকে অপারেশনের পর ছাড়পত্র নিয়ে চলেও গেছেন। ওই রোগীরা প্রতি সপ্তাহে ফলোআপের জন্য আসবেন। তবে আস্তে আস্তে বোঝা যাবে দৃষ্টিশক্তি কতটুকু ফিরছে। অবস্থা বুঝে প্রয়োজন মতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের তথ্য সংগ্রহে গিয়ে পরিচালকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। সাক্ষাতের জন্য দুই ঘন্টা অপেক্ষার পর ডিএমসিএইচের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. আসাদুজ্জামান খবর পাঠান, তিনি এখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন না।

ভোরের আকাশ/ সু