কিছু মানুষের জন্মই হয় মানুষের সেবা করার জন্য। মানুষের কল্যাণই তাদের কাছে মুখ্য। উপকার করার মধ্যেই তারা খুঁজে পান আত্মতৃপ্তি আর পরম আনন্দ। তাদেরই একজন রাজিয়া সামাদ ডালিয়া। মানুষের বিপদে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। গড়ে তুলেছেন হাসপাতালসহ নানা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। মানবসেবার স্বীকৃতিসহ এরই মধ্যে তিনি ‘শেরপুরের মাদার তেরেসা’ খ্যাতি পেয়েছেন।
রাজিয়া সামাদ ডালিয়ার জন্ম ১৯৪৩ সালের ১ ডিসেম্বর শেরপুর শহরের খরমপুর এলাকায়। ১১ ভাই বোনের মধ্যে তিনি মধ্যম। তিনি চট্টগ্রাম মহিলা কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। তার পিতা মরহুম খান বাহাদুর ফজলুর রহমান ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার চিফ হুইপ। তার মাতার নাম লুৎফুন্নেছা।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুস সামাদের সঙ্গে ১৯৬৪ সালে অক্টোবর মাসে তার বিয়ে হয়। ঢাকার সোবহানবাগের সরকারি কলোনির স্বামীর বাসায় কাটে তাদের দাম্পত্য জীবন। এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে ১৯৮১ সালে স্বামী আব্দুস সামাদ মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ১৯৮৩ সালে ঢাকায় ইংরেজি মাধ্যম একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সাত বছর শিক্ষকতা করে ঢাকায় আরাম আয়েশের জীবন ছেড়ে ১৯৯০ সালে নিজ জন্মস্থান প্রত্যন্ত অঞ্চল শেরপুর শহরে চলে আসেন।
শেরপুরে এসেই অর্থের অভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর চষ্টা করেন। তিনি তার পিতার গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার ফটিয়ামারীতে প্রথমে উপমা বিদ্যালয় ও পরে শহরের সজবরখিলা মহল্লায় উপমা হাসপাতাল চালু করেন। ১৯৯৭ সালে শহরের খরমপুর মহল্লায় শেরপুর ডায়াবেটিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন।
পরবর্তী সময়ে এটাকে ডায়াবেটিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়। এ জন্য শহরের মাধবপুর এলাকায় হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে সাধারণ হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এখানে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটা চালু করতে সাড়ে ৪ হাজার স্কয়ার ফুট জায়গার প্রয়োজন। এ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তিনি ওই হাসপাতালের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
শেরপুরে প্রথমবার চালু করেছেন হার্ট ফাউন্ডেশন। এরই মধ্যে তার পৃষ্ঠপোষকতায় যাত্রা শুরু করেছে রাজিয়া সামাদ শিশু ফাউন্ডেশন ও আই টি সেন্টারের কাজ। শুধু তাই নয়, শিশুদের জন্য খেলাঘর সংগঠন থেকে শুরু করে গড়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
মানবতার সেবায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শেরপুরের এই মহীয়সী নারী হয়ে উঠেছেন সবার প্রিয় ডালিয়া আপা। ডায়াবেটিক হাসপাতালের দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা সহায়তার জন্য রাজিয়া সামাদ সুদমুক্ত ঋণ ও আর্থিক অনুদান চালু করেছেন। ফি বছর ৫ লাখ টাকার তহবিল থেকে প্রতি জনকে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয় ওষুধ কেনার জন্য। প্রায় ৪০ জন দরিদ্র রোগী নারী পুরুষ বর্তমানে ঋণ সুবিধাভোগী।
শুধু ডায়াবেটিক হাসপাতালে নয়, আর্ত্ম-মানবতার সেবায় তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। দরিদ্র রোগীদের তিনি বিভিন্ন চিকিৎসক এবং বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
শেরপুর সরকারি জেলা সদর হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতার জন্য তিনি একজন আয়া রেখে দিয়েছেন। যার মাসিক বেতন রাজিয়া সামাদ ডালিয়া প্রতি মাসে নিজ তহবিল থেকে পরিশোধ করেন। তিনি শহরের বিভিন্ন এলাকায় পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বৃক্ষরোপণ আন্দোলন ও রোপণকৃত বৃক্ষ রক্ষায় কমিউনিটি সভা অব্যাহত রেখেছেন।
বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম পরিচয় পৌষ সংক্রান্তির পিঠা উৎসব। শেরপুরে নারীদের একত্রিত করে রাজিয়া সামাদ ডালিয়া ‘উজ্জয়িনী’ নামে একটি নারী সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি ওই সংগঠনের মাধ্যমে নারীদের উন্নয়নে বিভিন্ন কাজ শুরু করেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৫শ নারী নকশী কাঁথা তৈরি করার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন স্বাবলম্বিতা অর্জন করেছেন। উজ্জয়িনীর মাধ্যমে অনেক গরিব মানুষ তাদের দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেয়েছে। উজ্জয়নীর ব্যবস্থাপনায় এবং শেরপুর রোটারি ক্লাব ও ময়মনসিংহের বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালের সহযোগিতায় প্রতি বছর নাম মাত্র মূল্যে ছানি পড়া অসংখ্য রোগীর চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার করা হয়।
বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম পরিচয় পৌষ সংক্রান্তির পিঠা উৎসব। শেরপুরের নারীদের একত্রিত করে উজ্জয়িনী নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই উজ্জয়িনী মহিলা সংগঠনের মাধ্যমে ৬ বছর ধরে শেরপুরে শীতের পিঠা উৎসব হয়ে আসছে। এছাড়া রাজিয়া সামাদ ডালিয়া বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল; আইভিশন-২০২০; সদর হাসপাতাল রোগী কল্যাণ পরিষদ; রক্ত সৈনিক বাংলাদেশ এর শেরপুর জেলা শাখার সভাপতি। খান বাহাদুর ফজলুর রহমান ফাউন্ডেশন; সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট; জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ; সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন); মাদকবিরোধী আন্সদোলন শেরপুর; সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন; পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন; বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন; রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত।
দরিদ্র, দুস্থ, অসহায় ও নিম্নবিত্ত মানুষের যেকোনো প্রয়োজনে ছুটে যান রাজিয়া সামাদ ডালিয়া। ৮১ বছর বয়সেও তিনি রক্ত দান করেন।
মহামারী করোনা প্রতিরোধে বিধিনিষেধ চলাকালে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার দুস্থ ও অসহায় মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেন তিনি। গ্রামের বাড়িতে এতিম ছেলে মেয়েদের রেখে পড়ালেখার সুযোগ করে দেন। বর্তমানে অতিদরিদ্র ১৫ জন ছেলে মেয়ে তার সহায়তায় পড়ালেখা করছে। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত আছেন কয়েকজন। ১৯৯০ সালের দিকে রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া দুজন কন্যা শিশুকে নিজের পরিচয়ে বড় করেছেন এই মহিয়সী। তাদের একজন শাহানা সামাদ। ইতিহাসে মাস্টার্স শেষ করে ঢাকা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার পদে সরকারি চাকরি করছেন। অপরজন মাস্টার্স শেষ করে ঢাকা সেনানিবাসে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কর্মরত। শাহানা বলেন, একটি পরিবার একটি পরিচয় দিয়েছেন তিনি (রাজিয়া সামাদ)। তার অবদানের কথা কখনো ভুলব না। দুসন্তানের জননী রাজিয়া সামাদ ডালিয়া তাদেরকেও নিজের সন্তান বলে পরিচয় দেন।
রাজিয়া সামাদ ডালিয়া শেরপুর শহরে তার পিতার কবরের পাশে গড়ে তুলেছেন হার্ট ফাউন্ডেশন; ছিন্নমূল শিশুদের জন্য করেছেন রাজিয়া সামাদ শিশু ফাউন্ডেশন। আমৃত্যু মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চান তিনি।
ডালিয়া শুধু মানবসেবা নয়; প্রকৃতিপ্রেমীও। শহরের দুর্গানারায়ণপুর মহল্লার নিজ বাড়িতে ‘আনন্দধাম’ চত্বরে গড়ে তুলেছেন নানা জাতের দুর্লভ প্রজাতির ফুল বাগান। হিতৈষী মানুষটির অবসর সময় কাটে বাগান পরিচর্যা আর বই পড়ে। তার বাড়িতে ফলজসহ প্রায় ২ হাজার প্রজাতির গাছ রয়েছে।
রাজিয়া সামাদ ডালিয়া জানান, মানবসেবায় আসার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তার খালা। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে ঢাকার জমি, রাজশাহীতে শ্বশুরবাড়ির জমি, শেরপুরের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ওয়ারিশ সম্পত্তি সবই গেছে। কিন্তু তাতে কোনো আপসোস নেই তার। তিনি বলেন, আমি হয়তো সমাজটাকে বদলাতে চেয়েছি। সেটা করতে পেরেছি কি-না জানি না। তবে চেষ্টা করেছি। এক সময় নিজের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেই সব করেছি। কিন্তু এখন কাজে প্রতিনিয়ত আমার ভাই-বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব শুভাকাক্সক্ষীরা সবাই সহায়তা করে যাচ্ছেন। তবে কাজ করতে গেলে টাকা কোনো সমস্যা না। সমস্যা মানসিকতার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কত লোকের পাশে দাঁড়াতে পারি এটাই আমার চিন্তা।
রাজিয়া সামাদ ডালিয়া সম্পর্কে শেরপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক শিব শংকর কারুয়া বলেন, ডালিয়া আপা প্রকৃতপক্ষে একজন মহিয়সী নারী। তিনি তার সবকিছু অসহায় মানুষের জন্য উৎসর্গ করে চলেছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, এলাকার সবাই তাকে ‘ডালিয়া আপা’ বলেই ডাকেন। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ৮১ বছর বয়সেও চেহারায় নেই ক্লান্তির ছাপ।
ভোরের আকাশ/ সু